কেন বাংলাদেশিরা চিকিৎসার জন্য ভারতের উপর ভরসা করেন?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:৪৯
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত ক্রমেই আস্থার সংকটে পড়ছে। সরকারি বাজেট বৃদ্ধি ও বেসরকারি বিনিয়োগ সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের জন্য মানসম্মত ও সাশ্রয়ী চিকিৎসাসেবা অধরাই থেকে গেছে। ফলে প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি রোগী উন্নত চিকিৎসার আশায় ভারতে যাচ্ছেন। এতে দেশ থেকে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা বেরিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে চিকিৎসা প্রত্যাশীদের প্রধান অভিযোগ হলো রোগ নির্ণয়ের দুর্বলতা। অনেক সময় সঠিকভাবে রোগ শনাক্ত না হওয়ায় চিকিৎসা ব্যর্থ হয়। অপ্রত্যাশিত বিল, গোপন খরচ, নিম্নমানের ওষুধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা রোগীদের আস্থা নষ্ট করছে। ফলে তারা বিদেশমুখী হচ্ছেন।
ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশিদের মতে, সেখানে রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা উন্নত ও নির্ভরযোগ্য। আধুনিক ডায়াগনস্টিক সুবিধা, দক্ষ চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স এবং স্বচ্ছ বিলিং ব্যবস্থা রোগীদের আস্থা বাড়িয়েছে। ভারতের হাসপাতালগুলোতে রোগীকে কেন্দ্র করে সেবা দেওয়া হয়, যেখানে চিকিৎসার প্রতিটি ধাপ স্পষ্টভাবে জানানো হয়।
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। এটি ভারতের মোট মেডিকেল ট্যুরিস্টের প্রায় ৫২ শতাংশ। বিশেষ করে কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু ও দিল্লির হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশি রোগীর ভিড় সবচেয়ে বেশি।
কেন ভারতে চিকিৎসা সেবা নিতে যায় এ বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি?
- সঠিক রোগ নির্ণয়: উন্নত ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সুবিধা।
- দক্ষ চিকিৎসক: বিশেষায়িত চিকিৎসক ও সার্জনের সহজলভ্যতা।
- স্বচ্ছ বিলিং: চিকিৎসা ব্যয় তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট ও নির্ধারিত।
- পরিচ্ছন্নতা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ: হাসপাতালের পরিবেশ নিরাপদ ও মানসম্মত।
- বিকল্প চিকিৎসা: আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথি ব্যবস্থাও জনপ্রিয়।
বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার জনের বিপরীতে হাসপাতালের শয্যা মাত্র ০.৮৮টি, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড তিনটি। প্রতি ৮৩০ জনে একজন ডাক্তার, প্রতি ১১,৫৩১ জনে একজন ডেন্টিস্ট এবং প্রতি ৫৬,৫৯৯ জনে একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছেন। নার্সের সংখ্যা প্রতি ১০ হাজার জনে ছয়জনেরও কম। ঢাকাকেন্দ্রিক সেবাব্যবস্থা গড়ে ওঠায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠী চরম বৈষম্যের শিকার।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৩-৭৪ শতাংশই রোগীদের নিজ পকেট থেকে দিতে হয়। স্বাস্থ্যবিমার আওতায় রয়েছে মাত্র ২.৫ শতাংশ মানুষ। ফলে একটি গুরুতর রোগ পরিবারকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেয়। তুলনায় জাপানে আউট-অব-পকেট ব্যয় মাত্র ১১ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশে তা ৭৪ শতাংশ, কার্যত অনিয়ন্ত্রিত।
স্বাস্থ্য নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আস্থা ফিরিয়ে আনতে জরুরি স্বাস্থ্য বাজেট ধাপে ধাপে জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। চিকিৎসাসেবার মান মূল্য নির্ধারণ ও বিলিং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীন অ্যাক্রেডিটেশন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন, কম খরচের স্বাস্থ্যবিমা চালু এবং ঢাকার বাইরে অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি।
বাংলাদেশে চিকিৎসা প্রত্যাশীরা ভারতে যান মূলত রোগ নির্ণয়ের নির্ভরযোগ্যতা, দক্ষ চিকিৎসক ও স্বচ্ছ সেবার কারণে। দেশের স্বাস্থ্য খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু বাজেট বৃদ্ধি নয়, বরং মান নিয়ন্ত্রণ, জবাবদিহি ও নৈতিকতার ভিত্তিতে সংস্কার জরুরি। তা না হলে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক রোগী বিদেশমুখী হতে থাকবে।
logo-1-1740906910.png)