
যমুনা ফাউন্ডেশন নার্সিং কলেজ যমুনা ব্যাংকেরই একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান, যা যমুনা ফাউন্ডেশনের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে ইএসসি ইন নার্সিং এবং ডিপ্লোমা ইন নার্সিং কোর্সের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বাংলাদেশের নার্সিং বিষয়ক পড়ালেখার বিভিন্ন দিক নিয়ে মাইগ্রেশন কনসার্ন কথা বলেছে প্রতিষ্ঠানটির প্রশিক্ষক ইফতেখার আহমেদের সাথে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: আমরা জানি, পুরো পৃথিবীতেই নার্সিং পেশা একটি চাহিদাসম্পন্ন পেশা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই চাহিদাটা কেমন, মানে বাংলাদেশে নার্সিং পেশায় প্রতি বছর কি পরিমাণ শূন্যপদ তৈরি হয়?
ইফতেখার আহমেদ: বর্তমানে বাংলাদেশে লক্ষাধিক নার্সের পদ শূন্য আছে। প্রতি বছর ৪০-৫০ হাজার শিক্ষার্থী সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হচ্ছে এবং প্রতি বছরই একই পরিমাণ নার্স পাস করে চাকরির বাজারে ঢুকছে। কিন্তু সবাই যে শুরুতেই চাকরিতে ঢুকতে পারছে, বিষয়টি তা নয়। প্রতি বছর গড়ে ২০-২৫ হাজার শূন্যপদ তৈরি হচ্ছে, সেখানে চলতি শিক্ষার্থীরা চাকরির সুযোগ পাচ্ছে। বাকি যে ২০-২৫ হাজার শিক্ষার্থী, তারা কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে তারা বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছে অথবা বিদেশে চলে যাচ্ছে।
মা.ক: নার্সিং পেশায় আসতে চাইলে একজন শিক্ষার্থীকে কী করতে হবে বা কীভাবে সে এই পেশায় নিজেকে প্রস্তুত করবে– যদি বিষয়টি বলেন?
ই. আ: নার্সিং একটি মহৎ পেশা। অন্যান্য আর দশটা পেশার মতোই নার্সিং পেশাতেও প্রয়োজন হয় সঠিক প্রশিক্ষণের। এর জন্য তাকে ভর্তি হতে হবে কোনো প্রতিষ্ঠানে। নার্সিং পেশায় ডিগ্রি তিন ধরনের হয়- ডিপ্লোমা ইন নার্সিং, বিএসসি ইন নার্সিং এবং মিডওয়াইফারি। এই তিনটি কোর্স বর্তমানে চালু আছে আমাদের দেশে। এ তিনটি কোর্সের ভর্তি পরীক্ষাও হয় আলাদা আলাদা। নার্সিং পেশায় কেউ নিয়োজিত হতে চাইলে দুটি বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে- এক, বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি, দুই হলো মানসিক প্রস্তুতি। নার্সিংয়ের পড়ালেখা শুরু হয় এইচএসসির পর। যারা এ পেশায় প্রশিক্ষণ নিতে চান, তাদের ন্যূনতম যোগ্যতা এইচএসসি পাস হতে হবে। সরকারিভাবে একটি কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নার্সিং এ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এ পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থী একশতে ন্যূনতম ৪০ নম্বর পেলে পাস বলে বিবেচিত হবেন এবং তিনি বাংলাদেশের যে কোনো বেসরকারি নার্সিং কলেজে ভর্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। মেধা তালিকার ভিত্তিতে সরকারি কলেজ বা ইনস্টিটিউটগুলো শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকে। শিক্ষার্থীর সুযোগ- সুবিধা অনুযায়ী, বেসরকারি কলেজ বা ইনস্টিটিউট বাছাই করে থাকেন সাধারণত।
বিএসসি ইন নার্সিং ৪ বছরের কোর্স। এ কোর্স পরিচালিত হয় কোনো না কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। এ কোর্সে ভর্তি হতে চাইলে এসএসসি ও এইচএসসিতে সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড থাকাটা বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে ডিপ্লোমা ইন না্র্সিং বা ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সে ভর্তি হতে চাইলে সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড না হলেও চলে। ডিপ্লোমা কোর্স দুটি তিন বছরের হয়। এর পাশাপাশি কেয়ার গিভার এর জন্য আলাদা একটি শর্ট কোর্স থাকে। ডিপ্লোমা বা বিএসসির পাশাপাশি অনেকে ৬ মাস থেকে এক বছর মেয়াদি এই কোর্সটি করানো হয়।
মা.ক: নার্সিং পেশায় অধ্যয়নের খরচ কেমন হয় আর কী কী বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়– এ বিষয়ে যদি একটু ধারণা দিতেন।
ই. আ: নার্সিং পেশায় অধ্যয়নের জন্য সরকারিভাবে ন্যূনতম একটি ফি দিয়ে ভর্তি হতে পারেন একজন শিক্ষার্থী। সরকার এ শিক্ষায় বিভিন্নভাবে বৃত্তি দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে গেলে একজন শিক্ষার্থীর তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সে আনুমানিক ২-৩ লক্ষ টাকা প্রয়োজন এবং ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি কোর্সে আনুমানিক ৩-৫ লক্ষ টাকা প্রয়োজন হতে পারে।
বিএসসি ইন নার্সিংয়ের কারিকুলাম প্রস্তুত হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে। সেখানে প্রথম বছরে তাদের পড়ানো হয় ফান্ডামেন্টালস ইন নার্সিং, এনাটমি, মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি; দ্বিতীয় বছরে পড়ানো হয় হেথ এসেসমেন্ট, ফার্মাকোলজি, সার্জিক্যাল নার্সিং, ক্রিটিক্যাল কেয়ার নার্সিংয়ের মতো বিষয়গুলো। তৃতীয় বছরে কমিউনিটি হেলথ নার্সিং, সাইকিয়াট্রিক নার্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শেষ বছরে মিডওয়াইফারি বা ধাত্রী বিদ্যা, নার্সিং এডুকেশন, নার্সিং ম্যানেজমেন্ট, রিসার্স ইন নার্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়্।
ডিপ্লোমার সাথে বিএসসি কারিকুলামের কিছু বিষয়ে মিল আছে। তবে ডিপ্লোমা যেহেতু তিন বছরের, ফলে সব বিষয় এ কোর্সে পড়ানো হয় না। এর কারিকুলাম তৈরি থেকে কার্যক্রম পরিচালনা তত্ত্বাবধান করে থাকে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল।
মা.ক: সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কত নার্সিং কলেজ আছে- এ রকম কোনো পরিসংখ্যান কি আছে আপনাদের কাছে?
ই. আ: বর্তমানে সরকারিভাবে পরিচালিত নার্সিং ট্রেইনিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫০ থেকে ৫৫টির মতো। আর বেসরকারিভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৬০-এর কিছু বেশি।
মা.ক: সরকারিভাবে বিএমইটি কি আপনাদের সাথে কোনো কাজ করে?
ই. আ: বিএমইটি ঠিক সরাসরি আমাদের সাথে কোনো কাজে সম্পৃক্ত নয়, তবে সরকারি একটা নির্দেশনা আছে, শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ ভাগ বৃত্তি দিতে হয়। আমাদের প্রতিষ্ঠান যমুন ফাউন্ডেশন প্রতি বছর ৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকে, যার মধ্যে ২ জনকে এই বৃত্তি দিয়ে থাকে।
মা.ক: নার্সিং পেশা যেহেতু স্বাস্থ্য সেবার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত, ফলে এই পেশায় প্রশিক্ষণের মান নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। যে কেউ চাইলেই তো আর ট্রেইনিং দিয়ে নার্সিং পেশার সার্টিফিকেট দিয়ে দিতে পারে না। এর মান নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করা হয়, কারা এই প্রশিক্ষণ কলেজ বা ইনস্টিটিউটগুলোর মান তদারকি করে?
ই. আ: সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতো সরকার কর্তৃক প্রণীত কারিকুলাম অনুসরণ করছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যারা বিএসসি ডিগ্রি প্রদান করছে, তারা সরাসরি কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের কারিকুলাম ও শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রন করে থাকে। আর ডিপ্লোমা কোর্সগুলোর জন্য সরকারি যে কাউন্সিলটি আছে, তারাই তদারকি করে, কারিকুলাম প্রস্তুত থেকে পরীক্ষা নেয়া – সবই করে থাকে। তবে দিন দিন এর চাহিদা বৃদ্ধির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই যথাযথ নিবন্ধন ছাড়াই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তবে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিউওয়াইফারি কাউন্সিল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতি বছরই কলেজ ও ইনস্টিটিউটগুলোর মান বিষয়ক প্রতিবেদন এবং মানোন্নয়নের তালিকা প্রকাশ করে। ফলে একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমের মান সেই তালিকা থেকে দেখে বোঝা যায়।
মা.ক: নার্সিং প্রশিক্ষণের মান বজায় রাখার পেছনে অনেক কারণ আছে, যেমন সেই প্রতিষ্ঠানের ফ্যাসিলিটিজ কি আছে, তাদের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক শিক্ষা কতখানি দিতে পারছে, ইন্টার্ন করার সুযোগ কতখানি আছে ইত্যাদি। আপনাদের এই কলেজ বা ইনস্টিটিউটগুলো এই ফ্যাসিলিটিজগুলো কীভাবে এনশিউর করে?
ই. আ: নার্সিং সেবায় দুই ধরনের প্রশিক্ষণ থাকে। একটি একাডেমিক শিক্ষা, আরেকটি ব্যবহারিক শিক্ষা। থিউরিটিক্যাল প্রশিক্ষণটা আমরা কারিকুলাম অনুসরণ করে ক্লাসরুমেই নিশ্চিত করি আর সবচেয়ে জরুরি যেটা, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ; সেটি নিশ্চিত করতে আমাদের কাজ করতে হয় কোনো হাসপাতালের সাথে। বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি নিজস্ব হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ফ্যাসিলিটিজ থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশে যেহেতু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই এই সক্ষমতা নেই, ফলে তারা কোনো না কোনো বড় হাসপাতালের সাথে যৌথভাবে কাজ করে। যেমন আমরা যমুনা ফাউন্ডেশন নার্সিং কলেজ কাজ করি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাথে। আমাদের শিক্ষার্থীরা এই দুটি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধীনে ইন্টার্ন করার সুযোগ পায়।
মা.ক: একটি বিষয়ে জানতে চাই, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে প্রচুর নার্স যাওয়ার সুযোগ আছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচুর নার্স প্রয়োজন হয়। এমনকি সরকারিভাবেও বিদেশে প্রচুর নার্স নিয়োগের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিজ্ঞাপন দেখি আমরা, বোয়েসেল থেকে নিয়োগের কথা জানতে পারি। এই যে নার্সিং কোর্স অনার্স বা ডিপ্লোমা পর্যায়ের আপনারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, বিদেশে নিয়োগের জন্য আলাদা করে কি কোনো বিষয় বিবেচনা করছেন?
ই. আ: ধন্যবাদ, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেছেন। আমরা বিদেশে আমাদের শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ বিবেচনায় নিয়ে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি দুটি ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স করাচ্ছি। একটি আরবি ভাষা, আরেকটি ইংরেজি ভাষা। আমরা মনে করি, নার্সিং সেবায় ভাষা জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন রোগীর সাথে যথাযথ যোগাযোগ স্থাপন করতে হলে ভাষা জানতেই হবে। তাই মধ্যপ্রাচ্যের চাকরির বাজারের কথা বিবেচনায় নিয়ে আরবি ভাষা শিক্ষা দিচ্ছি আমাদের শিক্ষার্থীদের, আবার ইউরোপ বা উন্নত দেশে যেন আমাদের শিক্ষার্থীরা কাজ করতে পারে, সে বিবেচনায় ইংরেজি ভাষা শিক্ষা দিচ্ছি। এই ভাষা প্রশিক্ষণটি আমাদের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে করাচ্ছি। একজন প্রশিক্ষিত আলেমের অধীনে আরবি ভাষা ও একজন আইইএলটিএস প্রশিক্ষকের অধীনে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চলমান আছে।
মা.ক: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেয়ার জন্য।
ই. আ: আপনাকেও ধন্যবাদ।