Logo
×

Follow Us

মতামত

মোহম্মদ আবুল বাশার, বিশেষ সাক্ষাৎকার - শেষ পর্ব

হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমায় দেশে রেমিট্যান্সে সুবাতাস বইছে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ১৭:৫২

হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমায় দেশে রেমিট্যান্সে সুবাতাস বইছে

(অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, যা প্রবাসী আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৪ সালে ব্যাংকটি রেমিট্যান্স আহরণে দেশের ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে দ্বিতীয় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮১ কোটি ডলার, যা টাকার অঙ্কে ২১ হাজার কোটি টাকারও বেশি । ব্যাংকটির অর্জন ও রেমিট্যান্স কার্যক্রম সম্পর্কে মাইগ্রেশন কনসার্নের সাথে কথা বলেছেন ব্যাংকটির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহম্মদ আবুল বাশার। আজ এ সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব)

মা.ক.: একটা বিষয় হচ্ছে প্রযুক্তি। বিশেষ করে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে টাকা আদান-প্রদান কার্যক্রমে দিন দিন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে এবং এই কার্যক্রমকে গতিশীল ও সহজ করে দিচ্ছে। এ খাতে অগ্রণী ব্যাংক কতটা প্রযুক্তি নির্ভর? 

মোহম্মদ আবুল বাশার:  প্রযুক্তির যুগে এর সাথে তাল মিলিয়ে আপনাকে তো চলতেই হবে। আমরাও সময়ের সাথে সাথে নিজেদের আপগ্রেড করে নিচ্ছি। আমাদের এ প্রযুক্তি তা রিয়েল টাইমে অর্থনৈতিক লেনদেন সমাধা করছে। প্রবাসীদের পাঠানো টাকা রিয়েল টাইমে দেশে পৌঁছে যাচ্ছে। হুন্ডিতে কী হতো? হুন্ডিতে দুটি জিনিস আমাদের প্রবাসীর ভাইরা পেত। প্রথমত, হায়ার রেট; পাচারকৃত টাকার আধিক্যে দুই টাকা-তিন টাকা সব সময়ই তারা প্রবাসীদের দিত। এর বেশির ভাগ টাকাই অবৈধ। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো সময়। আমরা কিন্তু দিনের রেমিট্যান্স দিনে ক্রেডিট করতে পারতাম না। এটা এক দিন, দুই দিন, তিন দিন এমনকি সাত দিনও লেগে যেত। তখন তারা হুন্ডিতে টাকা পাঠিয়ে দিত। সে বেশি রেটও পেল, আবার টাকাটা সাথে সাথেও পেল। এমনও হয়েছে, প্রবাসী হুন্ডির কাছে টাকা দেয়নি, কিন্তু এদিকে তার স্বজন হাতে টাকা পেয়ে গেছে। হয়তো সাত দিন পর প্রবাসী বেতন পেয়ে সে টাকাটা শোধ করত। ফলে প্রবাসীরা এই সেবায় সন্তুষ্ট ছিল। তারা তো আসলে এত বিষয় বোঝে না, হুন্ডিতে টাকা পাচার, দেশ রিজার্ভ শূন্য– এসব কিছু নিয়ে প্রবাসীরা ভাবে না। তারা জানে যখন টাকা পাঠায়, তখন স্বজন টাকা পায় আবার রেটও পাওয়া যায় বেশি। ফলে প্রবাসীরা এতেই সন্তুষ্ট ছিল। এখন কিন্তু আস্তে আস্তে সচেতনতা বাড়ছে প্রবাসীদের মধ্যে। শুধু অগ্রণী ব্যাংকই না, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের ওপর ব্যাপক আর্থিক তদারকি আছে। আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি। প্রবাসীরাও বুঝতে পারছে। তারা জানছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসার বিরূপ প্রভাব, দেশের অর্থনীতিতে তাদের কন্ট্রিবিউশনসহ ভবিষ্যৎ সঞ্চয় তহবিল গঠন করতে বৈধ পথে টাকা পাঠানোই মঙ্গল। এই টাকা ট্যাক্স ফ্রি। ফলে অবৈধ পথে আসা টাকার যেহেতু ট্যাক্স দেয়া হয় না, ওই টাকাটা অবৈধ বা কালো টাকা। এই টাকাটা বিনিয়োগ করতে পারছে না। ফলে এই প্রবাসীরাও বুঝতে পারছে যে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোই মঙ্গল। আর তাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমরা দিচ্ছি বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার। আমাদের যে পরিচালনা পর্ষদ আছে, তাদের কাছে আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি, যারা সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠায় এমন ৫০ জন ব্যক্তিকে পুরস্কার দিচ্ছি, সর্বাধিক রেমিট্যান্স প্রেরণকারীকে পুরস্কার দিচ্ছি। আমাদের দুটি এক্সচেঞ্জ হাউস আছে সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়ায় আমাদের এক্সচেঞ্জ হাউসের ৬টা শাখা আর সিঙ্গাপুরে আছে ৫টা শাখা। এছাড়া সারা বিশ্বে আমাদের ৮৫টা এক্সচেঞ্জ হাউসের অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে। এদের মাধ্যমেও আমরা বিভিন্ন রকম প্রণোদনামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি। আমরা চেষ্টা করছি এই সংখ্যাগুলো আরো বাড়ানোর জন্য। যেসব দেশে আমাদের প্রবাসী ভাইরা আছে, সেসন দেশে নতুন করে আমরা চুক্তিতে যাচ্ছি, এক্সচেঞ্জ হাউস স্থাপনের চেষ্টা করছি। এক দেশে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও আমরা টাইআপে যাচ্ছি।

মা.ক.: আপনার ব্যক্তিগতভাবে প্রবাসীর কর্মীদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা আছে বলেছেন। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে, একজন প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠাতে কোন বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়?

মোহম্মদ আবুল বাশার: একজন প্রবাসী তাৎক্ষণিক টাকা পাঠানোর দক্ষতা ও সেবাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। সে যখন দেখে দুদিনেও টাকা পাচ্ছে না, তখন তার মাথা ঠিক থাকে না। এ জন্য আমরা এই বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, সঙ্গে সঙ্গে রিয়েল টাইমে টাকাটা যেন প্রেরকের কাছ থেকে গ্রহীতার হাতে পৌঁছানো যায়। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির আপগ্রেডেশন করতে হবে, আপ-টু-ডেট প্রযুক্তির সাথে থাকতে হবে। সেবাগ্রহীতাকে আন্তরিক সেবা দিতে হবে। এসবের ব্যত্যয় হলেই সেটার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সের ওপর। যখনই কোনো ব্যাংক সার্ভিসটা খারাপ দেবে, তখনই কিন্তু রেমিট্যান্স যারা গ্রহণ করে, সেই প্রবাসীর স্ত্রী বা বাবা-মা কিন্তু প্রেরককে জানিয়ে দেয়, এই ব্যাংকের সার্ভিস খারাপ, তুমি ওই ব্যাংকে পাঠাও। এটা কিন্তু একজন প্রবাসী তার অন্যান্য প্রবাসী বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আলাপ করে, তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, পরামর্শ দেয় বা নেয়। ফলে এটা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে, কোন ব্যাংকের সার্ভিস ভালো, কোন ব্যাংকের খারাপ। যার কারণে আমরা এই জায়গাটায় চেষ্টা করি অন্তত সার্ভিস যেন আমাদের কোনোভাবে হ্যাম্পার না হয়। আমাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা আছে, কেউ যদি কোথাও রেমিট্যান্স গ্রহণ করতে এসে কোনো হয়রানির স্বীকার হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স দেখাই, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে একশনে যাই। এভাবে আমরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিই এবং আমাদের জেলা পর্যায়ের কন্ট্রোলিং অফিসারদের সেভাবেই বলা আছে।

মা.ক.: আপনার কাছে একটা বিষয় জানতে চাইব, নিয়ন্ত্রক সংস্থায় বা বাংলাদেশ ব্যাংকের আর কী সহযোগিতা পেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো গতিশীল করতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো, আপনার পরামর্শ কী হতে পারে?

মোহম্মদ আবুল বাশার: এখানে আপনারা জানেন, আজ মুদ্রাবাজারে ডলারের সংকটসহ যে সামগ্রিক অস্থিরতা, সেটা তো আমরাই সৃষ্টি করেছি। আমরাই টাকা পাচার করে দিয়েছি, অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীরা ক্যাশ ডলার কিনে বাজারে কৃত্তিম সংকট তৈরি করেছে– সবই তো করেছি। এসব কারণেই তো আমাদের মুদ্রাবাজার অস্থির হয়েছে, রেমিট্যান্স মার্কেটও কিন্তু হ্যাম্পার হয়েছে। প্রবাসীরা বুঝতে পারছিল না ডলারের রেট কোথায় যাবে, রেট বাড়বে, নাকি কমবে। তারাও হয়তো কারেন্সিগুলো ধরে রেখেছে। এ রকম অনেক হয়েছে, হয়তো দিন দিন দাম কমছে কারেন্সির, প্রবাসীর ভাবছে আজ না পাঠিয়ে তিন দিন পর পাঠালে হয়তো আরো রেট বেড়ে যাবে। ফলে ওই সময়গুলোতে আমাদের মার্কেটে কারেন্সি স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। আমাদের ইম্পোর্টের তো প্রচুর অবলিগেশন, সে পেমেন্ট করতে আমরা সমস্যায় পড়েছি আপনারা জানেন। সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে জ্বালানি, সার ইত্যাদি কেনার ডলার পেমেন্ট– আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, সরকারি এই বিল পেমেন্টে সবচেয়ে বেশি সাপোর্টটা অগ্রণী ব্যাংক দিয়ে থাকে। এই পেমেন্ট দিতে গিয়ে কিন্তু আমাদের হিমশিম খেতে হয়। এই ধরেন, পেট্রোবাংলার মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ওভারডিউ থাকত, এই ১৫ দিন আগে আমরা জিরো করে দিয়েছি। এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের রেমিট্যান্স বেড়েছে, এক্সপোর্ট বেড়েছে– এসব দিয়েই আমরা এই পেমেন্টগুলো দিয়েছি। মাঝখানে তো এমন অবস্থান ছিল, আমরা ফরেন পেমেন্টগুলো দিতে পারছিলাম না। মাশাআল্লাহ এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে পরিস্থিতি। আমি বলব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খুব দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি।

মা.ক.: ধন্যবাদ, আমরা আলোচনার শেষের দিকে চলে এসেছি। রেমিট্যান্স যোদ্ধা যাদের বলি আমরা, সেই প্রবাসীদের প্রতি আপনার কিছু বলার আছে কিনা বা তাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্যাংকগুলোর আরো কিছু করার আছে কিনা- এ বিষয়ে যদি আপনার কোনো পরামর্শ থেকে থাকে।

মোহম্মদ আবুল বাশার: এটা তো বলেছি, আমরা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের উৎসাহিত করতে প্রচুর প্রণোদনা, উপহার দিয়ে থাকি। তাদের পরিবারের কাছে সরাসরি এই উপহারগুলো হস্তান্তর করি। বিশেষ করে আমাদের মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের যে এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো, সেখানে আমাদের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, আমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আমাদের সিইও বছরে অন্তত একবার যাচ্ছেন। তারা সেখানকার দূতাবাসসহ স্থানীয় প্রবাসীদের সাথে মতবিনিময়, প্রচারণা করছেন। সেখানকার সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রেরককে পুরস্কার দিচ্ছেন, সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। হাইকমিশনার মহোদয় সেসব অনুষ্ঠানে থাকেন। এ বছরও এই তো কিছুদিন আগেই আমাদের এমন অনুষ্ঠানে হয়েছে। এছাড়া সরকার যে প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পুরস্কার করেন, সেখানেও আমরা আমাদের পুরস্কার বিজয়ীদের নিয়ে আসি, তাদের সম্মানিত করি।

মা.ক.: বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্স আহরণের বিষয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন কিনা বা সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অগ্রণী ব্যাংক কতখানি প্রস্তুত বলে মনে করেন আপনি?

মোহম্মদ আবুল বাশার: ধন্যবাদ। হুন্ডি হলো বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটা আগেও ছিল এখনো আছে, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে সবচেয়ে বড় খুশির খবর হলো এই হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমেছে, অর্থ পাচার বন্ধ হয়েছে। এর প্রভাবে রেমিট্যান্স খাতে সুবাতাস বইছে। আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা। এই মুহূর্তে মুদ্রাবাজার সুস্থির, ফলে এটাও একটা বড় সুখবর। ফলে রেমিট্যান্স মার্কেটের সবচেয়ে বড় দুটি নিয়মক যখন নিয়ন্ত্রণে আছে আমাদের সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ও ব্যবস্থাপনায়, তখন রেমিট্যান্স নিয়ে আশাবাদী হওয়াই যায়। আর দিন দিন যত নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে, সে প্রযুক্তিগুলোর সাথে আমরা ব্যাংকগুলো একীভূত হয়ে যাচ্ছি, প্রযুক্তির সুবিধাগুলো নিয়ে নিচ্ছি আমাদের গ্রাহকদের দ্রুত ও সুনিপুণ সেবা প্রদানের জন্য। এখন একজন প্রবাসী যখন টাকা পাঠাচ্ছেন, তখনই টাকা ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে, প্রেরক এবং গ্রাহক দুজনই সাথে সাথে মেসেজ পেয়ে যাচ্ছে। বিষয়টিতে স্বচ্ছতা থাকছে। আমরা সব ব্যাংকই চাচ্ছি, কীভাবে প্রবাসীদের আরেকটু বাড়তি সুবিধা দেয়া যায়। এই যে একটা ইতিবাচক মনোভাব প্রবাসীদের জন্য বাড়তি কিছু করার– এটা প্রবাসীদের উৎসাহিত করছে।

মা.ক.: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।                                              মোহম্মদ আবুল বাশার:  আপনাদেরও ধন্যবাদ। 

Logo