মোস্তফা ইমরান রাজু, বিশেষ সাক্ষাৎকার, শেষ পর্ব
ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় থেকে যাওয়ার প্রবণতা থামাতে হবে

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ০০:১৪

মোস্তফা ইমরান রাজুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনার সুন্দরবন বিধৌত কয়রা থানার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবা সাংবাদিক মোস্তফা শফিকুল ইসলাম কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পারিবারিক আবহে ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে রাজু ২০১১ সালে বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে যোগ দেন। পরে ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। সেখানে নিজের ব্যবসা ও চাকরির পাশাপাশি আরটিভির মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। বর্তমানে দৈনিক কালবেলার মালয়েশিয়া প্রতিনিধি ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলা টেলিভিশন টিবিএন টোয়েন্টিফোরের মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের মালয়েশিয়া সফর, দেশটিতে কর্মী যাওয়ার সম্ভাবনা, কর্মী গণহারে অবৈধ হয়ে পড়া, দেশটিতে চলমান গ্রেফতার অভিযান, কর্মীদের করণীয় নিয়ে মোস্তফা ইমরান রাজু কথা বলেছেন মাইগ্রেশন কনসার্নের সাথে। মোস্তফা ইমরান রাজুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব স্মারক। ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ শেষ পর্ব।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: কী কী কারণে মালয়েশিয়ায় কর্মীরা অবৈধ হয়ে বিপদে পড়ছেন? এর জন্য কারা দায়ী?
মোস্তফা ইমরান রাজু: এই যে ধরেন, মালয়েশিয়া নিয়ে কথা হচ্ছে যে, শ্রমবাজার খুলছে। ৪ লাখ ৭৫ হাজার কর্মী এসেছে লাস্ট আড়াই বছরে। তারপর আরো এক থেকে দেড় লক্ষ মানুষ এসেছে ট্যুরিস্ট ভিসায়। যারা ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেছে, তারা এয়ারপোর্ট কনট্রাক করে এসেছে। তারপর তারা কাজের উদ্দেশ্যে থেকে গেছে। এটা আমাদের জন্য বিরাট খারাপ নজির তৈরি হয়েছে। গোটা জনশক্তি রপ্তানি বাজারে এর খারাপ প্রভাব পড়েছে। কারণ এই লোকগুলো কিন্তু এসে আর ফিরে যায়নি। মালয়েশিয়ায় থেকে গেছে। এই যে দেখেন আপনি এসেছেন ট্যুরিস্ট ভিসায়, তারপর আপনি থেকে গেছেন, কাজে যোগ দিয়েছেন। আপনি কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এক বা দুই মাস পরে অবৈধ হয়ে গেছেন। এখন যাদের অবৈধ হিসেবে ধরা হচ্ছে, তারা কিন্তু প্রায় সবাই এই ট্যুরিস্ট ভিসায় থেকে যাওয়া লোকজন। এই কাজগুলো থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। এখনো অনেকে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকার চুক্তিতে এভাবে ট্যুরিস্ট ভিসায় আসছেন ‘বডি কন্ট্রাকে’। আসার পরে একটা কাজে ঢুকে পড়েন। তারপরে যখন অভিযান চলে, তখন পুলিশের কাছে ধরা খান। অনেকে পালিয়ে বেড়ান। অনেক দালাল বলে যে তুমি মালয়েশিয়ায় গেলেই বৈধতা পেয়ে যাবে। কিন্তু একটা বিষয় জানা দরকার, যদি বৈধতা দেয়ও… ট্যুরিস্ট ভিসায় যারা থেকে অবৈধ হয়ে পড়েছে, তারা বৈধতা পাবে না। কেবল যারা কাজের ভিসায় এসে অবৈধ হয়ে পড়েছে, তাদের জন্য এই সুযোগ তৈরি হতে পারে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: মালয়েশিয়ায় অবৈধরা জনে-জঙ্গলে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু অবৈধদের বৈধ করার বিষয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে কিনা? যারা অবৈধ হয়ে গেছে তারা কী করবে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: মালয়েশিয়া সরকারের এখন একটা সুযোগ চলছে, যাকে বলা হচ্ছে আরটিকে-টু। যদি আপনি অবৈধ হয়ে পড়েন, নিজেকে অনিরাপদ মনে করেন, তাহলে আপনি এই প্রোগ্রামের আওতায় আত্মসমর্পণ করবেন। ৩০০ থেকে ৫০০ রিংগিত জরিমানা দিয়ে নিজ নিজ দেশে চলে যেতে পারবেন। এটা শুধু বাংলাদেশিদের জন্য না, সব দেশের নাগরিক, যারা মালয়েশিয়ায় অবৈধ হয়ে পড়ছেন তাদের জন্য। এই প্রোগ্রাম চলবে এক বছর ধরে। আমি বলব, অবৈধ হয়ে পড়লে দেশে ফেরত যাওয়াই ভালো। কারণ আপনার পরিবার দেশে হয়তো আপনার জ্ন্য দুশ্চিন্তা করছে। যারা প্রবাসে আপনার আশপাশে আছেন, তারা কিন্তু এ নিয়ে চিন্তা করেন।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: যদি কেউ আত্মসমর্পণ করে, মালয়েশিয়া ছেড়ে দেশে চলে আসে, তাহলে কী পরে আবার দেশটিতে যেতে পারবে? দেশটির অভিবাসন আইন কী বলে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: এটাকে মালয়েশিয়া সরকার বলছে সাধারণ ক্ষমা। সাধারণ ক্ষমার আওতায় জরিমানা দিয়ে আপনি মালয়েশিয়া ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু পাঁচ বছরের জন্য ব্ল্যাক লিস্টে থাকবেন। পাঁচ বছরের মধ্যে আপনি আর মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন না। পাঁচ বছর পর আপনি যদি মনে করেন, আপনি বৈধভাবে আসবেন, তাহলে আবার আসতে পারবেন। নতুন করে পাসপোর্ট করবেন, নতুন করে আবেদন করবেন।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: ক্ষমার সুযোগ যদি কেউ না নেন, তাহলে কী হবে? এর ইম্প্যাক্ট কী হতে পারে।
মোস্তফা ইমরান রাজু: এটার ইম্প্যাক্ট খুব খারাপ। এমন হলে আপনাকে ধরবে, কোর্টে ওঠাবে, শাস্তির পরিমাণ ঠিক করবে। দুই-তিন-ছয় মাস পর্যন্ত জেল হতে পারে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: শাস্তি হলে কী সেই আবার মালয়েশিয়া যেতে পারবেন? বা কী ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: শাস্তি হলেও ব্ল্যাক লিস্ট হয় ৫ বছরের জন্যই। তবে অপরাধের মাত্রা গুরুতর হলে যেমন হত্যাচেষ্টা বা হত্যা, মাদকসহ ধরা পড়া; এসবের মতো অপরাধ করলে সারা জীবনের জন্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হতে পারে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: এই যে সবাই বলে ‘কলিং ভিসা’ চাই, সেটা কী আসলে? এটা কেন জনপ্রিয়? সবাই কেন যেতে চায়?
মোস্তফা ইমরান রাজু: মালয়েশিয়ায় লোকজন আসতে চান, তার বড় কারণ তারা ভালো থাকে। তার পরিবার ভালো থাকে। কিন্তু মালয়েশিয়ায় এসে যদি অবৈধ হয়ে যান, পালিয়ে বেড়ান তাহলে তো আপনার নিজের স্বপ্ন ভঙ্গ, পরিবারের স্বপ্ন ভঙ্গ। এ জ্ন্য একটু সচেতন হওয়া দরকার। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। আমি আশাবাদী এবার যদি শ্রমবাজার খোলে, তাহলে অল্প খরচে, নিরাপত্তসহ লোকজন আসতে পারবে মালয়েশিয়ায়। আমি আশাবাদী, আমি আস্থা রাখতে চাই।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: মালয়েশিয়ায় কী পাসপোর্ট; বিশেষত ই-পাসপোর্টের সংকট আছে এখনো?
মোস্তফা ইমরান রাজু: মালয়েশিয়ায় ই-পাসপোর্টের সংকট এখনো আছে। আগে তীব্র ছিল, এখন একটু ইজি হয়েছে। কিন্তু এখনো আছে। সমাধান হয়ে গেছে সেটা বলা যাবে না। এনিয়ে প্রবাসীরা এখনো বিরক্ত। এই পাসপোর্টের জন্য প্রবাসীদের আন্দোলন পর্যন্ত করতে হয়েছে। অনেক কিছু হয়েছে এই পাসপোর্টের জন্য। জটিলতা কিছুটা কমেছে কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি।
একটা বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যেমন ধরেন আপনি যদি ইন্টারনেটে মালয়েশিয়ান হাইকমিশন নামে সার্চ দেন, তাহলে তিন থেকে চারটা ঠিকানা আসবে। আমি এক দশকে দেখেছি, তিন থেকে চারবার হাইকমিশনের ঠিকানা পরিবর্তন হয়েছে। বারবার কী হাইকমিশনের ঠিকানা পরিবর্তন হয়? আপনি যদি পাসপোর্ট করতে চান, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের দুইটা ঠিকানা আসবে। ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম এক অফিসে চলে আবার পাসপোর্টের জন্য আলাদা অফিস আছে। এই যে নানা ঠিকানায় নানা অফিস, মানুষ কিন্তু বিভ্রান্ত হয়। এক অফিসে গেলে তারা আরেক অফিসে যেতে বলে। এতে করে মানুষের ভোগান্তি হয়। মানুষ খুব বিরক্ত এ নিয়ে। ই-পাসপোর্টের জন্য নরমালি আপনি একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইবেন পাবেন না। কিন্তু আবার টাকা দিলে ঠিকই পাবেন। পাসপোর্ট যেন সহজে প্রবাসীরা পায় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: মালয়েশিয়ান দূতাবাস বিষয়টি কী গুরুত্বের সাথে দেখছে না বলে মনে করছেন?
মোস্তফা ইমরান রাজু: গুরুত্বের সাথে দেখলে তো ফলটা আমি, আমরা পেতাম। সেটা তো পাচ্ছি না। ভালো কিছু করে থাকলে তো আমরা ভালো ফল পেতাম। যেহেতু আমরা ফল পাচ্ছি না, তো আমাদের বুঝতে হচ্ছে যে কাজে গাফিলতি আছে। হাইকমিশনের ব্যর্থতা বলব না, তবে তাদের আরো সচেতন হতে হবে। তবে হাইকমিশন অব্যবস্থাপনার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। আপনি প্রবাসীদের কাছে পাসপোর্ট পৌঁছে দিতে পারছেন না, সেটা যেভাবেই হোক সেই দায় তো হাইকমিশনেরই।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ মাইগ্রেশন কনসার্নকে সময় দেয়ার জন্য।
মোস্তফা ইমরান রাজু: আপনাকেও ধন্যবাদ।