মোস্তফা ইমরান রাজু, বিশেষ সাক্ষাৎকার, পর্ব-২
কাজের নিশ্চয়তা দিয়েই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে হবে

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ২১:০১

মোস্তফা ইমরান রাজুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনার সুন্দরবন বিধৌত কয়রা থানার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবা সাংবাদিক মোস্তফা শফিকুল ইসলাম কয়রা উপজেলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পারিবারিক আবহে ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে রাজু ২০১১ সালে বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে যোগ দেন। পরে ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। সেখানে নিজের ব্যবসা ও চাকরির পাশাপাশি আরটিভির মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। বর্তমানে দৈনিক কালবেলার মালয়েশিয়া প্রতিনিধি ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলা টেলিভিশন টিবিএন টোয়েন্টিফোরের মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের মালয়েশিয়ায় সফর, দেশটিতে কর্মী যাওয়ার সম্ভাবনা, কর্মী গণহারে অবৈধ হয়ে পড়া, দেশটিতে চলমান গ্রেফতার অভিযান, কর্মীদের করণীয় নিয়ে মোস্তফা ইমরান রাজু কথা বলেছেন মাইগ্রেশন কনসার্নের সাথে। রাজুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব স্মারক। ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ দ্বিতীয় পর্ব।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: আপনি বলছেন, মালয়েশিয়ার জন্য নিরাপদ মাইগ্রেশন নীতিমালা থাকা দরকার। বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলবেন?
মোস্তফা ইমরান রাজু: দেখুন, এই যে আমরা এখন চাইছি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে। শুধু মালয়েশিয়ায় লোক পাঠালেই যে আমরা অনেক কিছু করে ফেলব বিষয়টি কিন্তু তেমন না। নিরাপদ অভিবাসন নীতিমালা তৈরি করা দরকার, বিশেষ করে মালয়েশিয়ার জ্ন্য। অনিরাপদ অভিবাসন একেবারে অপ্রত্যাশিত। আমরা এটা চাই না। তাই বলছি, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার আগে এখানে যারা আছেন বা যারা আসবেন, তাদের জ্ন্য নীতিমালা করা। এজ্ন্য যারা মালয়েশিয়ায় আসবেন, তাদের সবার জ্ন্য যেন কাজ থাকে। সবাই যেন ঠিকমতো বেতন পায়। এক কোম্পানির ভিসায় এসে যেন অন্য কোম্পানিতে কাজ করতে না হয়। কর্মী যেন কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হয়। এসব দেখভালের জ্ন্য যা যা করা দরকার, তা যেন করা হয়। তারপর ভাবা দরকার মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে নতুন করে লোক আসবে কিনা?
মাইগ্রেশন কনসার্ন: শ্রমবাজার খুললে নতুন যারা বাংলাদেশ থেকে যাবে, তারা তো অবৈধ হয়ে যাবে না? ফলে মালয়েশিয়ায় নতুন করে কর্মী গেলে সমস্যা কোথায়?
মোস্তফা ইমরান রাজু: আপনি ঠিকই বলেছেন, এখন যারা নতুন আসবে, তারা তো আর অবৈধ হবে না। কিন্তু তারা যে কাজ নিয়ে আসবে, সেই নিশ্চয়তা তো আপনি দিতে পারছেন না। এখন পর্যন্ত আপনি বলছেন সেই সিন্ডিকেটের কথা। সেই ১৪ হাজার কোটি টাকার কথা। কিন্তু সেগুলো নিয়ে তো আপনি কোনো স্টেপ নেন নাই। আপনি এখন পর্যন্ত একটা ঘোষণা দেন নাই যে, গত সরকারের আমলে শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট করে যারা পকেট কেটেছে, বিপদে ফেলেছে, প্রতারিত করেছে… তাদের আমরা কাজ করতে দেব না। শ্রমবাজারটা এমন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে, যেখানে এমওইউ বা চুক্তিনামার সব শর্তগুলো মানা হবে। ওইখানে যা লেখা থাকবে, তাই মানা হবে। যদি বলা হয়, ৭২ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় আসবে, তাহলে যেন ৭২ হাজার টাকাতেই মালয়েশিয়ায় আসতে পারে। কিন্তু এই কমিটমেন্টে তো আপনি যাচ্ছেন না। এখানে তো বাংলাদেশের জ্ন্য আলাদা নীতিমালার প্রয়োজন নাই। মালয়েশিয়ায় ভারত থেকে লোক আসছে; পাকিস্তান, নেপাল থেকেও লোক আসছে। সেই নীতিটাই অ্যাপ্লাই করা হোক। কিন্তু আমাদের জ্ন্য আলাদা করে এসব ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং করতে হচ্ছে কেন?
মাইগ্রেশন কনসার্ন: কিন্তু এই যে সিদ্ধান্তের কথা বলা হলো, ১৭ হাজার ৭৭৭ জন; যাদের ভিসা হওয়ার পরও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেনি, তাদের মধ্যে প্রথম দফায় ৭ হাজার ৯৬৪ জন অচিরেই যেতে পারবে যে বলা হয়েছিল, তাদের ব্যাপারে কী হতে যাচ্ছে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: এই যে বলা হয়েছিল, ১৭ হাজার ৭৭৭ জন, যারা ভিসা পেয়েও যেতে পারেনি, তারা যে যেতে পারবে সেটা তো প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের বৈঠকেই সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল। সেই মোতাবেক কাজ চলছে। এটাকে নতুন কোনো খবর আমি বলব না। এই যে আটকে পড়া কর্মী যারা যেতে পারেনি, সেটাই তো আমাদের ব্যর্থতা। এটার জন্য এতো বৈঠকেরও কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: তাহলে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের কী মানে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: দেখেন, আমরা কিন্তু কখনো শুনিনি, ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠক করেছে ভারতের সাথে, পাকিস্তান বা নেপালের সাথে। বা অন্য কোনো দেশের সরকারের লোকজন এখানে এসে বৈঠক করেছে। বা মালয়েশিয়ানরা ভারতে গিয়ে বৈঠক করেছে। এসব আমরা শুনি না। হয় হয়তো। কিন্তু এসব বৈঠক হয় যে আগে কারা সিন্ডিকেট করেছে, এখন কারা সিন্ডিকেট করবে। নতুন করে কে যুক্ত হবে, কে যুক্ত হবে না। এছাড়া এসব বৈঠকের আর কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। আগে হয়তো ১০ জন করত। এখন হয়তো ১০ থেকে বেড়ে ২৫, ২৫ থেকে বেড়ে ৫০, এখন ৫০ থেকে ১০০ জন। মনে হচ্ছে এখন কারা কাজ করবে, কারা অতিরিক্ত মুনাফা লুটবে। এখন প্রশ্ন, আমার দেশের সাধারণ মানুষকে এখন কারা শোষণ করবে, তার জন্য কি এসব বৈঠক?
মাইগ্রেশন কনসার্ন: কিন্তু এখন তো একটা হাইপ তৈরি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে, হয়তো খেয়াল করছেন যে চলো চলো মালয়েশিয়া চলো, এই বৈঠকের পর…
মোস্তফা ইমরান রাজু: আমি দেশের মানুষকে বলব, মালয়েশিয়া আসার জ্ন্য এত বেশি উদগ্রীব হবেন না। বিদেশে আসতে চান আসবেন। কিন্তু উতলা বা অধৈর্য হবেন না। যেখানে যাবেন, সেটা কতখানি নিরাপদ, যে কোম্পানিতে যাবেন বলে বলা হচ্ছে, সেই কোম্পানিটা আদতে আছে কিনা সেটা জানবেন। সেটা তো নিশ্চিত হতে হবে। সেখানে কাজ আছে কিনা, সেটা জানতে হবে। মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণার জ্ন্য অপেক্ষা করেন। এই যেমন ধরেন নিউজ হলো বড় বড়। দেখবেন, লোকজন পাসপোর্ট জমা দেয়া শুরু করে দেয়। দেখবেন, পাসপোর্টের বড় বড় বান্ডিল দেখা যায় দালালদের হাতে। কিন্তু আপনি কেন পাসপোর্ট দালালের হাতে দেয়া শুরু করেছেন? আগে তো জানুন যে কোথায় যাবেন, কেন যাবেন, কত টাকা লাগবে? সেখানে বেতন কত হবে?
মাইগ্রেশন কনসার্ন: সেটা কর্মীরা কীভাবে জানতে পারবে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: এখানে প্রতিটি কোম্পানি লোক নেয়ার আগে একটা অ্যাগ্রিমেন্ট বা চুক্তির কাগজ রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে পাঠায়। তাতে এ টু জেড সব লেখা থাকে। যারা জানে তাদের কাছ থেকে সেটা জেনে নিতে পারেন। এখন ডিজিটাল যুগে কোনো কোম্পানির অস্তিত্ব আছে কি নাই, সেটা জানা তো জটিল কাজ না। মোবাইলে সার্চ দিলেও তো সেটা পাওয়া সম্ভব। এসব জানার চেষ্টা করবেন। একেবারে বিদেশে আসার জন্য তড়িঘড়ি করে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। মালয়েশিয়া চমৎকার একটা দেশ। অনেক সুযোগ আছে। অদক্ষ মানুষের কাজের এত সুন্দর সুযোগ পৃথিবীর কম দেশেই আছে। তাই মালয়েশিয়ায় আসতে গিয়ে দালালের কাছে জিম্মি হবেন না।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: কর্মীরা তো রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেই বিদেশে যায়। সে ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিই যদি ঠকায়, সে ক্ষেত্রে কী করার থাকে? সরকার এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখতে পারে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: দেখুন, সরকারের সব কিছুই করার আছে। যে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিদেশে লোক পাঠায়, সেসব রিক্রুটিং এজেন্সির সব ডাটা সরকারের কাছে আছে। যে লোকটি বিদেশে আসছে, সে কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সি ফেস করেই আসছে। ফলে সরকার যদি চায় যে তাদের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়া কর্মীগুলো কোন দেশে গেছে, কেমন আছে, কোনো জালিয়াতির মুখে পড়েছে কিনা? সব কিছুই জানতে পারে। যদি কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মীরা জালিয়াতিতে পড়ে, তাহলে সেই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনা। এটা করার জন্য সরকারকে কিন্তু খুব বেশি প্রেসার নেয়ার দরকার নাই। সরকার যদি একটু চায় তাহলে সম্ভব। যদি প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে চায়, তাহলেই সম্ভব।
চলবে…