মোস্তফা ইমরান রাজু, বিশেষ সাক্ষাৎকার, পর্ব-১
ভিসা থাকার পরও মালয়েশিয়ায় অবৈধ হয়ে পড়ছেন কর্মীরা

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ০১:৪৬

মোস্তফা ইমরান রাজুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনার সুন্দরবন বিধৌত কয়রা থানার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবা সাংবাদিক মোস্তফা শফিকুল ইসলাম কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পারিবারিক আবহে ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে রাজু ২০১১ সালে বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে যোগ দেন। পরে ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। সেখানে নিজের ব্যবসা ও চাকরির পাশাপাশি আরটিভির মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। বর্তমানে দৈনিক কালবেলার মালয়েশিয়া প্রতিনিধি ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলা টেলিভিশন টিবিএন টোয়েন্টিফোরের মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের মালয়েশিয়ায় সফর, দেশটিতে কর্মী যাওয়ার সম্ভাবনা, কর্মী গণহারে অবৈধ হয়ে পড়া, দেশটিতে চলমান গ্রেফতার অভিযান, কর্মীদের করণীয় নিয়ে মোস্তফা ইমরান রাজু কথা বলেছেন মাইগ্রেশন কনসার্নের সাথে। রাজুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব স্মারক। ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ প্রথম পর্ব।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টার সফরের সময় নানা সুখবর এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা নিজেই জানিয়েছেন, এক থেকে দেড় লাখ কর্মী বিভিন্ন দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যেতে পারবে। বাংলাদেশ থাকবে সেই অগ্রাধিকার তালিকায়। এমন সুখবরও তিনি দিয়েছেন। আপনার কাছে কি মনে হচ্ছে, এই সফরের ইতিবাচক দিক আসলে কোনগুলো?
মোস্তফা ইমরান রাজু: আপনি ঠিকই বলেছেন, প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টার মালয়েশিয়ায় সফরের সময় দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে খবর ছাপা হয়েছে। অনেক ইতিবাচক খবর এসেছে। তবে ওয়ার্কিং কমিটির যে বৈঠক হয়েছে এবং সেই বৈঠক থেকে যে খবর এসেছে, সেটা আমার কাছে কোনো সুখবর বলে মনে হয়নি। কারণ মালয়েশিয়ায় ওয়ার্কিং কমিটির যে বৈঠক হয়েছে আর ঢাকাতে যে বৈঠক হলো ২১ ও ২২ তারিখে, সেসব বৈঠকের ফলাফলটা কী? আপনি কী এখন বলতে পারবেন, মালয়েশিয়ায় কোন সেক্টরে কতজন লোক আসবে? এই সিদ্ধান্ত কি হয়েছে? এই সিদ্ধান্ত কি হয়েছে যে, মালয়েশিয়ায় কত টাকায় লোক আসতে পারবে? এই সিদ্ধান্ত কিন্তু হয়নি। দুটি বৈঠকই কিন্তু হয়েছে এসব সুনির্দিষ্ট ফলাফল ছাড়া। আমরা যারা মালয়েশিয়ায় আছি, আমরা আসলে এখন চাইছি না যে, নতুন করে বাংলাদেশ থেকে কর্মী আসুক।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: কেন এ কথা বলছেন? কেন চাইছেন না যে, নতুন করে দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাক।
মোস্তফা ইমরান রাজু: খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই টপিক নিয়েই আমি কথা বলতে চাই। এখন যেসব কর্মী মালয়েশিয়া আছেন, বিশেষ করে যাদের কাগজপত্র নাই, তাদের সময়গুলো, তাদের দিনগুলো কীভাবে কাটছে ঠিক এই মুহূর্তে? আমি যখন আপনার সাথে কথা বলছি, এই মুহূর্তেই কোথাও না কোথাও মালয়েশিয়া সরকারের অবৈধদের ধরপাকড় চলছে। তাহলে আপনি চিন্তা করেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, তারা কিন্তু বনে-জঙ্গলে পালিয়ে আছে। তারা তো সেই চিন্তা করছে, তারা কোথায় পালাবে। কোথায় পালালে তারা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবে সেই চেষ্টা তারা করে যাচ্ছে। তারা চারদিকে ছোটাছুটি করছে। এমন একটা সময়ে যদি আপনি নতুন লোকদের নিয়ে আসেন, তাহলে নতুন লোকগুলোকে আমরা কীভাবে স্বাগত জানাতে পারি।
যারা আছেন তারাই তো নিরাপদ নন, তাদের বৈধতার সংকট আছে। কোথাও না কোথাও আটক হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সেই শ্রমবাজারে নতুন করে কর্মী নিয়ে আসার বিষয়ে যদি আপনি উদগ্রিব হন, আর আমরা আমাদের চোখের সামনে যা দেখছি, সেখানে নতুন লোক নিয়ে আসার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: মালয়েশিয়ায় কী ধরনের অভিযান হচ্ছে এখন? বাংলাদেশের কত অবৈধ কর্মী আছে দেশটিতে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: এখানে একটা বিষয় আপনাকে বুঝতে হবে, এখানে যারা আছেন, তারা কেন অবৈধ হয়ে পড়লেন। আবার বৈধ কর্মীও কিন্তু আটক হচ্ছেন। মালয়েশিয়ায় একটা বিষয় কিন্তু অনেকেই জানেন না। যেমন ফ্রি ভিসার নাম করে প্রতি বছর হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ লোককে আনা হয়। বলা হয় তুমি যাবা, তোমার ফ্রি ভিসা আছে, তুমি যে কোনো জায়গায় কাজ করতে পারবা মালয়েশিয়াতে। আমি বলব, এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। মিথ্যা প্রলোভন। ট্র্যাপও বলতে পারেন। যারা ম্যানপাওয়ার ব্যবসা করে এই লোভ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে। কিন্তু এই দেশগ্রামের সাধারণ মানুষগুলোকে একেবারে বিপদের মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: বৈধ কর্মী কীভাবে আটক হন? সেটা কেন হচ্ছে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: বলছি, এই যে মালয়েশিয়ায় কাগজ নাই তারাই আটক হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। যাদের কাগজপত্র আছে তারাও আটক হচ্ছে। কাগজ আছে, ভিসা আছে তারপরও ধরা হচ্ছে। কারণ কী? কর্মীরা যে কোম্পানির নামে এসেছে সেই কোম্পানিতে তারা কাজ করছে না। এখন বলতে পারেন, কেন তারা সেই কোম্পানির কাজ করছে না? কারণ তাদের ফ্রি ভিসার নাম করে এনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখন যারা দেশ থেকে ফ্রি ভিসায় গেছে, তাদের তো কাজ দরকার। ইনকাম করতেই তো তারা গেছে মালয়েশিয়ায়। সো তারা যেখানে কাজ পাচ্ছে, সেখানেই কাজ করছে। তখন তাদের কাজের এরিয়া থেকে আটক করছে। ভিসায় এক কোম্পানির নাম কিন্তু কাজ করছে অন্য কোম্পানিতে। মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইনে কিন্তু সেটা অবৈধ। ফলে তাদের ধরে কিন্তু দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: কী পরিমাণ অবৈধ বাংলাদেশি আছেন? সংখ্যায় কতজন অবৈধ বাংলাদেশিদের ধরা হয়েছে সেই সংখ্যাটা জানা যায় কিনা। এই ধরপাকড় কতখানি জটিল হতে পারে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: কত প্রবাসী বাংলাদেশি অবৈধ হয়েছেন, সেটা বলা মুশকিল। সেটা কেবল মালয়েশিয়া সরকারই জানে। একটা পরিসংখ্যান আপনাকে দিই, মালয়েশিয়া সরকার সব সময় চায় যে তার দেশে ২৫ শতাংশ অভিবাসী থাকুক। সেটা সব দেশের শ্রমিক মিলিয়ে। তাদের দেশে কত লোক আসতেছে, কত লোক এসে থেকে যাচ্ছে, ওভার স্টে করছে, কত লোক অবৈধ হচ্ছে, বৈধ- অবৈধ সব হিসাব কিন্তু মালয়েশিয়া সরকারের কাছে আছে। যখনই এই সংখ্যাটা বেড়ে যায়, তখনই কিন্তু তারা অভিযান শুরু করে। সংখ্যাটা বলা সম্ভব না। তবে আপনাকে বলি, জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: এর মধ্যে কতজন বাংলাদেশি?
মোস্তফা ইমরান রাজু: আটক করা বা ফেরত পাঠানোদের ভেতর কতজন বাংলাদেশি সেটা বলা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, এর মধ্যে বেশির ভাগই বাংলাদেশি। এখানে যদি আপনি অর্ধেকও করেন, তাহলেও সংখ্যাটা ২৪ হাজার বা তারও বেশি। এই সংখ্যাটা ১৫ দিন আগের। এই ১৫ দিনে সংখ্যাটা নিশ্চয়ই আরো বেড়েছে। আপনার সাথে কথা বলার সময়ও দেখছি দুই জায়গায় অভিযান চলছে। এই অভিযান কিন্তু একেবারে চিরুনি অভিযান যাকে বলে। একেবারে চারপাশ ঘিরে ধরে অভিযান। একজন একজন করে ধরে কাগজপত্র বাছাই করে এই অভিযান চলে। যাচাই-বাছাই করে হয় ছাড়া হচ্ছে বা ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগেও বলেছি, ভিসা আছে কিন্তু কাগজপত্রে যেখানে কাজ করার কথা, সেখানে না করে অন্য কোথাও কাজ করছেন তাকেও অবৈধ বলে ধরা হবে। ফলে মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন লঙ্ঘনের দায়ে তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে এ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তো এগুলো নিয়ে তো আমাদের সরকারের কাজ করা উচিত।
চলবে…