মোস্তফা ইমরান রাজু, মতামত, পর্ব-২
মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগে কোম্পানি ও কাজ সম্পর্কে জানতে হবে

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৫, ২০:৫৫

মোস্তফা ইমরান রাজুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনার সুন্দরবন বিধৌত কয়রা থানার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবা সাংবাদিক মোস্তফা শফিকুল ইসলাম কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পারিবারিক আবহে ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে তিনি ২০১১ সালে বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে যোগ দেন। পরে ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। সেখানে নিজের ব্যবসা ও চাকরির পাশাপাশি আরটিভির মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। বর্তমানে দৈনিক কালবেলার মালয়েশিয়া প্রতিনিধি ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলা টেলিভিশন টিবিএন টোয়েন্টিফোরের মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি কথা বলেছেন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, প্রবাসী বাংলাদেশিদের বর্তমান অবস্থা, কাজের সুযোগ, সমস্যা, সম্ভাবনা ও সংকট উত্তরণের উপায় নিয়ে। মাইগ্রেশন কনসার্নের পক্ষ থেকে তার সাথে কথা বলেছেন মাহবুব স্মারক। দুই পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে শেষ পর্ব।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: একটা বিষয় জানতে চাইব, মালয়েশিয়ায় পাম বাগানে প্রায়ই প্রচুর কর্মী নিয়োগ হয়। আসলেই কি যতখানি দেখা যায়, তত পরিমাণে কাজের সুযোগ আছে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: দেখুন, মালয়েশিয়ায় প্রচুর কাজের সুযোগ আছে। সবচেয়ে বেশি কর্মী কাজ করে কনস্ট্রাকশনে, এরপর এগ্রিকালচার বা কৃষিতে। ফলে এসব খাতে সব সময়ই প্রচুর লোকের চাহিদা থাকে। এখন সঠিক প্রক্রিয়ায় লোক না পাঠানোর কারণে এখানকার নিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে লোক না এনে অন্য দেশ থেকে লোক আনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই যে সিন্ডিকেট বলেন, এদের কারণে একজন কর্মীকে যে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়, এর ফলে কিন্তু নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানও সাফার করে। কারণ এখানকার মানবাধিকার সংগঠনগুলো যারা আছে, তাদের কাছে যখন এই খবরগুলো পৌঁছায়, তখন মালয়েশিয়ার সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়, ওই কোম্পানির ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। আপনি জানেন, ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশনের জন্য একদিকে যেমন দেশের সরকার ভুক্তভোগী হয়, অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও প্রেশারে পড়ে। এসব কারণে অনেক কোম্পানি ইচ্ছা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী না এনে অন্য দেশ থেকে কর্মী নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে স্থানীয় মালয়েশিয়ানরা বাংলাদেশিদের দারুণ পছন্দ করে, তারা অনেক পরিশ্রমী হয়, তারা সহজেই স্থানীয় ভাষা শিখে নিতে পারে, তারা সৎ হয়। এসব কারণে মালয়েশিয়ানরা বাংলাদেশিদের দারুণ পছন্দ করে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন কোন দেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে মালয়েশিয়ান কোম্পানিগুলো?
মোস্তফা ইমরান রাজু: বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এ রকম ১৪টি সোর্স কান্ট্রি থেকে লোক নেয় মালয়েশিয়া। আপনি অবাক হবেন, অনেক দেশে কিন্তু কর্মী পাঠাতে সরকার নিজেই সব খরচ দেয়। শুধু বাংলাদেশের জন্য এখানে নিয়মটা ভিন্ন। বাকি দেশগুলো খুব দ্রুত লোক পাঠাতে পারে, খরচ কম।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: এবার আপনার কাছ থেকে জানতে চাইব, মালয়েশিয়ায় কাজের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে কোন কাজগুলো আগে থেকে শিখে গেলে একজন কর্মীর মালয়েশিয়ায় চাকরি পাওয়া সহজ হয়, কোন ধরনের কাজের চাহিদা বেশি?
মোস্তফা ইমরান রাজু: মালয়েশিয়ার তিনটি বিষয় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য খুবই উপকারী। একটি হলো জলবায়, একটি হলো ধর্ম আর একটি ভাষা। এখানকার জলবায়ু বাংলাদেশের মতোই, বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম ও মালয় ভাষা শেখাটা বাংলাদেশিদের জন্য সহজ। ফলে বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিরা বেশি কমফোর্ট ফিল করে। বাংলাদেশ থেকে যেসব কর্মী আসে এ দেশে, তাদের বড় অংশই অদক্ষ এবং এরা অদক্ষ জেনেই নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিয়োগ দেয়। এখানে সবচেয়ে বেশি কর্মী নিয়োগ হয় কনস্ট্রাকশন সেক্টরে। এ সেক্টরে বিপুল পরিমাণে বাংলাদেশি কর্মী সুনামের সাথে কাজ করছে, ভালো বেতন পাচ্ছে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: বাংলাদেশিরা কোন কোন কাজ বেশি করেন?
মোস্তফা ইমরান রাজু: মালয়েশিয়ানরা বলে থ্রি-ডি; মানে ডার্টি, ডিফিকাল্ট অ্যান্ড ডেঞ্জারাস- এই তিন কাজের জন্য বাংলাদেশের কর্মীদের চাহিদা ব্যাপক। ক্লিনার হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশিরা। কঠিন পরিশ্রমের কাজগুলো করছে বাংলাদেশি কর্মীরা, বিপজ্জনক কাজগুলোও তাদের দিয়ে করানো হচ্ছে।এখানে অনেক ফ্যাক্টরি, প্ল্যানটেশন ফার্ম আছে, যেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের আধিপত্য আছে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: নতুন করে যারা যাবে, তারা কী ধরনের দক্ষতা অর্জন করে যেতে পারে বা প্রস্তুতি নিয়ে যেতে পারে মালয়েশিয়ায়?
মোস্তফা ইমরান রাজু: প্রস্তুতির আগে আমার মনে হয় একটি বিষয়ে ভীষণ সচেতনতা জরুরি, সেটা হলো একজন কর্মী কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে– এটা ভালোভাবে জেনে-বুঝে যাওয়া। যে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য যাচ্ছে, আদৌ সে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে কিনা। কারণ মালয়েশিয়ায় অনেক কোম্পানি আছে কাগজে-কলমে, বাস্তবে তার অস্তিত্ব নাই। তারা থার্ড পার্টি হয়ে কর্মী সাপ্লাই দেয়। ফলে কর্মীরা অনেক সুবিধাবঞ্চিত হয়।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: একজন কর্মী যিনি অদক্ষ, তিনি তো দেশেই অদক্ষ, ফলে তার পক্ষে কি সম্ভব নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যাচাই-বাছাই করা। সে ক্ষেত্রে সরকারের কী করণীয় আছে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: সরকারের তো অবশ্যই উদ্যোগী হওয়া উচিত প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। সরকার অনুমতি দিলেই কেবল একটি প্রতিষ্ঠান কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যেতে পারে। তবে যিনি আসবেন, তারও এখানে করণীয় থাকে। যে প্রতিষ্ঠানে তিনি যাবেন, তাদের সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নিয়ে তাকে যেতেই হবে। প্রতিষ্ঠান বড় হলে গুগলেই তাদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য থাকবে। এছাড়া চুক্তিপত্র ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে কাজের শর্তাবলি জেনে বুঝে-যাওয়া উচিত। আরেকটি বিষয়, একজন কর্মীকে মালয়েশিয়া বা অন্য কোথাও পাঠাতে হলে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো উচিত। বাংলাদেশে কাগজে-কলমে ট্রেইনিং দেয়, আসলে কতটা কার্যকর ট্রেইনিং দেয়া হয়, এটা সরকারকে মনিটর করা উচিত। সব দেশেরই কিছু সোশ্যাল নর্ম আছে, সেগুলো মেইনটেইন করা উচিত। কোথায় কীভাবে যেতে হবে, কাজের পোশাক পরে যত্রতত্র যাওয়া যাবে কিনা– এগুলো সম্পর্কে ধারণা একজন কর্মীকে দেশে থাকতেই দিয়ে দিতে হবে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: এখন যেহেতু সরকারিভাবে লোক নিয়োগ হচ্ছে না, তো বেসরকারিভাবে কোন কোন খাতে কর্মী যাওয়ার সুযোগ আছে মালয়েশিয়ায়?
মোস্তফা ইমরান রাজু: দেখুন, নতুন লোক আসার আগে পুরনো যারা অবৈধ আছেন, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। গেল বছরের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে দেশে ফিরিয়ে দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। এর একটা বড় অংশই বাংলাদেশি। এখনো অনেক বাংলাদেশি অবৈধ অবস্থায় আছেন। এদের বিষয়ে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন যেহেতু বৈধ হওয়ার আবেদনের সময়সীমা পেরিয়ে গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে কাগজপত্রবিহীন কর্মীদের নতুন করে বৈধতার আওতায় কিভাবে আনা যায় সেটি নিয়ে কাজ করা।প্রয়োজনে আলাপ আলোচনা শুরু করা যায়।
আর যদি শ্রমবাজার খোলে, তখন সুনির্দিষ্ট কোম্পানি বাছাই করে সঠিক প্রক্রিয়ায় কর্মী প্রেরণে জোর দিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। যে কর্মীটা যে কোম্পানিতে আসবে, সে কোম্পানিতে তার কাজের নিশ্চয়তা দিয়েই আনা উচিত।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, মালয়েশিয়ান একজন নিয়োগকর্তা একটি প্ল্যান্টেশনের মালিক নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিদায় জানাতে সপরিবারে এয়ারপোর্টে উপস্থিত হয়েছেন, বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানাচ্ছেন। এটাকে আপনারা মালয়েশিয়ান বাংলাদেশিরা কীভাবে দেখছেন বা আপনাদের মধ্যে কতখানি সাড়া পড়েছে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: আমি আগেই বলেছি, এখানকার স্থানীয়রা বাংলাদেশি কর্মীদের ভালোবাসেন, তাদের পছন্দ করেন। অনেক সামাজিক আয়োজনে এখানকার স্থানীয় নিয়োগ কর্তারা বলেন, বাংলাদেশি কর্মীদের পছন্দ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, তারা ওভারটাইম করতে চায়। অন্য দেশের কর্মীরা যেখানে ওভারটাইম করতে পছন্দ করে না, সেখানে বাংলাদেশি কর্মীরা আগে থেকেই বলে, আমরা কত ঘণ্টা ওভারটাইম করতে পারব।
বাংলাদেশি কর্মীরা পরিশ্রমী, বিশ্বস্ত ও সৎ। এ কারণেই স্থানীয়রা বাংলাদেশিদের পছন্দ করেন।
আপনি যে ভিডিওর কথা বললেন, এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে, অনেক নেগেটিভ নিউজের পাশাপাশি অনেক পজিটিভ নিউজও হচ্ছে বাংলাদেশিদের নিয়ে। এ ঘটনা এখানকার সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে, মালয়েশিয়ান পত্রিকাতেও এটি প্রচার পেয়েছে ভালোভাবে। এটি নিয়ে টেলিভিশনে নিউজ হয়েছে, সার্বিকভাবে একটা গুড ইম্প্যাক্ট পড়েছে বাংলাদেশিদের নিয়ে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে আর কী কী করা যেতে পারে?
মোস্তফা ইমরান রাজু: প্রথম কথা হলো এই শ্রমবাজার সব ধরনের সিন্ডিকেট মুক্ত করতে হবে। একজন কর্মী যখন মালয়েশিয়ায় আসবেন, অবশ্যই জেনে-বুঝে যাচাই করে আসবেন। সঠিক প্রতিষ্ঠানে এলে নিজের লাভ, দেশের লাভ। স্থানীয়দের সম্পর্কে জেনে আসবেন, সামাজিক বিষয়গুলো ভালোভাবে শিখে নেবেন। এভাবেই আপনি একজন সফল প্রবাসী কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: আপনাকে ধন্যবাদ
মোস্তফা ইমরান রাজু: আপনাদেরও ধন্যবাদ।