Logo
×

Follow Us

মতামত

মোস্তফা ইমরান রাজু, মতামত, পর্ব-১

মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেট বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৫, ১৯:২৮

মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেট বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে
মোস্তফা ইমরান রাজুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনার সুন্দরবন বিধৌত কয়রা থানার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবা সাংবাদিক মোস্তফা শফিকুল ইসলাম কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পারিবারিক আবহে ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে তিনি ২০১১ সালে বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে যোগ দেন। পরে ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। সেখানে নিজের ব্যবসা ও চাকরির পাশাপাশি আরটিভির মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। বর্তমানে দৈনিক কালবেলার মালয়েশিয়া প্রতিনিধি ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলা টেলিভিশন টিবিএন টোয়েন্টিফোরের মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি কথা বলেছেন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, প্রবাসী বাংলাদেশিদের বর্তমান অবস্থা, কাজের সুযোগ, সমস্যা, সম্ভাবনা ও সংকট উত্তরণের উপায় নিয়ে। মাইগ্রেশন কনসার্নের পক্ষ থেকে তার সাথে কথা বলেছেন মাহবুব স্মারক। দুই পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।  

মাইগ্রেশন কনসার্ন: মোস্তফা ইমরান রাজু আপনাকে স্বাগত। শুরুতেই আপনার কাছে জানতে চাই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বিষয়ে। কবে নাগাদ মালয়েশিয়ান শ্রমবাজার আবার বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য খোলা হতে পারে? মালয়েশিয়ায় বিপুল কর্মী নিয়োগের সুখবর দেয়া হচ্ছে নানা গণমাধ্যমে। আপনি যেহেতু মালয়েশিয়ায় আছেন, আপনার কাছে কী তথ্য আছে, কী বার্তা পাচ্ছেন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে?

মোস্তফা ইমরান রাজু: ধন্যবাদ আপনাকে; মালয়েশিয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার নিয়ে আপনারা আলোচনা করছেন। আসলে যে প্রশ্নটা করেছেন, আপনার মতো আমিও বাংলাদেশি মিডিয়া থেকে জেনেছি। তবে আমরা যারা মালয়েশিয়া থাকি, তারা স্থানীয় কোনো গণমাধ্যমে এ ধরনের কোনো সংবাদ দেখিনি এখন পর্যন্ত। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, ১২ লাখ কর্মী নেবে মালয়েশিয়া। এ বিপুল কর্মী যে বাংলাদেশ থেকেই নেবে এমনটা কিন্তু নয়। মালয়েশিয়ার যে ১৪টি সোর্স কান্ট্রি রয়েছে, সেসব দেশ মিলিয়ে এই কর্মী নিয়োগ হবে বলে জানানো হয়েছে বাংলাদেশি মিডিয়ায় বা সরকারের পক্ষ থেকে। তবে মালয়েশিয়ার কোনো গণমাধ্যমে এ ধরনের কোনো তথ্য বা অগ্রগতির কথা আমরা শুনিনি বা দেখিনি। মালয়েশিয়ার যে চিত্র আপনি  বলছিলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের পরিস্থিতি কী। এককথায় যদি বলতে হয়, মালয়েশিয়ায় এখন যারা আছেন তারাই কাজের সংকটে আছেন, তাদের হাতেই কাজ নেই। ফলে নতুন কর্মী নিয়োগের সংবাদটা কতখানি সঠিক, তা আমাদের জানা নেই।  

মাইগ্রেশন কনসার্ন: সে ক্ষেত্রে এ মাসেই যেটা আমরা শুনতে পাচ্ছি, যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ, যেটা দুই দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে তৈরি, যারা এই আটকে পড়া কর্মীদের নেয়ার ব্যাপারে কাজ করছেন, তাদের একটা মিটিং আছে পুত্রজায়ায়। সে মিটিংয়ের বিষয়ে কিছু জেনেছেন কিনা; কারা থাকবেন, কোনো আশাব্যঞ্জক সংবাদ পাওয়া যাবে?

মোস্তফা ইমরান রাজু: আমি আবারো বলছি, এই যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং বা জনশক্তি রপ্তানির বিষয়ে আমরা যা জেনেছি, এর সবই বাংলাদেশি মিডিয়ার কাছ থেকে। মালয়েশিয়ার গণমাধ্যম বা সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হচ্ছে না। তবে ১৫ তারিখ যে মিটিংয়ের কথা হচ্ছে, আমরা প্রত্যাশা করছি, যদি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে কোনো ইতিবাচক আলোচনা হয়, সেখানে অবশ্যই যেন সংস্কারের মাধ্যমে শ্রমবাজারটা চালু করা হয়। অতীতের মতো সিন্ডিকেট যেন না হয়- এটাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে।

মাইগ্রেশন কনসার্ন: যে সংস্কারের কথা বলছিলেন আপনি, আমরা জানি, এই সিন্ডিকেটের কথা এলেই যে দুই আমিনের কথা আসত, মালয়েশিয়ার এক আমিন ও বাংলাদেশের আরেক আমিন মিলে সিন্ডিকেট করে যে শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে সরকার পরিবর্তনে বাংলাদেশেও সেই সিন্ডিকেট ভেঙে গেছে বলে মনে করা হয়, কিন্তু মালয়েশিয়া কতখানি তৎপর এই সিন্ডিকেট ভাঙা নিয়ে। বায়রার অনেক সদস্য চান পুরনো সিন্ডিকেট আর না থাকুক। কিন্তু এ বিষয়ে মালয়েশিয়ায় কি মনোভাব দেখা যাচ্ছে?

মোস্তফা ইমরান রাজু: এটা আসলে খুব জটিল একটা প্রশ্ন।সিন্ডিকেট ভেঙেছে নাকি নতুন সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে। দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু সিন্ডিকেটটা তৈরি হচ্ছে বেসরকারি পর্যায়ে। এমওইউতে যা লেখা থাকছে, সেটার ধারেকাছেও যায় না কেউ। কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়, তাদের সুবিধা বঞ্চিত করা হয়। চুক্তিতে বলা থাকে একজন কর্মী যে কোম্পানিতে যাচ্ছে, সেই কোম্পানির কাজ থাকতে হবে। কোম্পানিতে থাকার পরিবেশ ভালো থাকতে হবে, তার চিকিৎসা ও পরিবেশ ভালো থাকতে হবে। সরকার নির্ধারিত বেতন কাঠামো থাকতে হবে, ওভারটাইমের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। এগুলো কিন্তু চুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটে না।

আপনি বলছিলেন সিন্ডিকেট থাকবে কিনা। সিন্ডিকেটের বিষয়ে বাংলাদেশকে একটা ভাইটাল রোল প্লে করতে হবে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ সরকারকে স্ট্রিক্ট থাকতে হবে, যদি সিন্ডিকেট থাকে, তাহলে আমরা এই শ্রমবাজারে লোক পাঠাতে ইচ্ছুক না। কারণ বাংলাদেশের হাতে আরো অনেক অপশন আছে মালয়েশিয়ার বাইরে। সিন্ডিকেট কিন্তু একপক্ষীয় হয় না, দুই পক্ষকেই এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে বলে আমি মনে করি। অতীতে যেটা হয়েছে, তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর সাথে আমার কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, তারা চান না সিন্ডিকেট হোক বা থাকুক। কিন্তু সফরের পরে তিনি বলেছেন, সিন্ডিকেট ছাড়া তাদের কিছু করার নাই। মোটকথা, এটার পুনরাবৃত্তি না হোক, এটাই আমাদের চাওয়া।

মাইগ্রেশন কনসার্ন: শুধু সিন্ডিকেটের কারণেই কি মালয়েশিয়ান কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়োগ দিতে অনাগ্রহ দেখায়, নাকি আরো কোনো কারণ আছে?

মোস্তফা ইমরান রাজু: হ্যাঁ, এটাই অন্যতম কারণ। মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের ধারাবাহিক কিছু প্রক্রিয়া আছে। কর্মীর যথাযথ মেডিকেল হতে হবে, ডিমান্ড লেটার ইস্যু করতে হবে, দূতাবাসের এটাচটেশন পেতে হবে। তারপর তার ভিসাসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে হয়। এই প্রক্রিয়াগুলো যখন অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হয়, তখনই একজন নিয়োগকর্তা নিরুৎসাহিত হয়। এসব জটিলতার কারণেই কিন্তু অনেকেই পিছিয়ে যায়।

আপনি জানেন, এখানে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের হাতে অনেক কাজ আছে। যাদের কর্মপরিবেশ ভালো। তারা কিন্তু নিয়োগের সময় কর্মীর কাছ থেকে এক টাকাও নেয় না বা নেয়ার নিয়ম নেই। আমাদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে কিন্তু এ রকমই বলা থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে একজন কর্মীকে চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেই মালয়েশিয়ায় আসতে হয়। অথচ নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান হয়তো জানেই না, তার কর্মীকে এত টাকা খরচ করে আসতে হয়েছে।

মাইগ্রেশন কনসার্ন: এই যে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানো, এটা কি শুধু বাংলাদেশ থেকেই হচ্ছে?

মোস্তফা ইমরান রাজু: না, শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, দুপাশ থেকেই হচ্ছে বলে আমি মনে করি। ধরেন একটি কোম্পানির ১০০ কর্মী প্রয়োজন, এখন প্রতিষ্ঠানকে সরকারের কাছ থেকে ১০০ কর্মীর ডিমান্ড লেটার ইস্যু করিয়ে আনতে হবে। এখানেই তাকে একটা বড় টাকা দিতে হয়। তার মানে দূর্নীতিটা এখান থেকেই শুরু হচ্ছে। যেহেতু শুরুটাই করাপশনের মাধ্যমে হচ্ছে, তার শেষটাও তাই হবে।

মাইগ্রেশন কনসার্ন:  সে ক্ষেত্রে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

মোস্তফা ইমরান রাজু: আপনি জানেন, সরকারি নিয়োগ প্রতিষ্ঠান বোয়েসেলের মাধ্যমে গত দু-এক বছরে ১৫-২০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় এসেছে, যাদের কোনো টাকাই খরচ করতে হয়নি। এমনকি সরকার তাদের পাসপোর্টটাও করে দিয়েছে। অন্যদিকে গত দুই বছরে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ৪-৫ লাখ কর্মী নিয়োগ হয়েছে মালয়েশিয়ায়। আমি বলতে চাচ্ছি, সরকারিভাবে বোয়েসেলের মাধ্যমে যদি এই ৪-৫ লাখ কর্মীর সবাইকে আনা সম্ভব হতো, তাহলে একদিকে কর্মীর খরচ কমে যেত, অন্যদিকে দূর্নীতি কমে যেত।

চলবে…

Logo