Logo
×

Follow Us

মতামত

মাফি ইসলাম, মতামত, ১ম পর্ব

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন‍্য স্বর্গ জার্মানি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৩৪

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন‍্য স্বর্গ জার্মানি
মাফি ইসলাম; একজন মিডিয়া গবেষক, সাংবাদিক এবং বর্তমানে জার্মানির ডার্মস্টাড ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপলায়েড সায়েন্সেসের ডক্টরাল সেন্টার ফর সাসটেইনেবিলিটির অধীনে পিএইচডি গবেষণায় নিয়োজিত। মাফি ২০২৪ সালে জার্মানির ডার্মস্টাড ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপলায়েড সায়েন্সেস থেকে মিডিয়া, প্রযুক্তি ও সমাজ বিষয়ে এবং ২০২১ সালে সুইডেনের ইউনিভার্সিটি অব গোথেনবার্গ থেকে রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ে দুটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। গণমাধ্যমে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের একাত্তর টেলিভিশনে, যেখানে তিনি পাঁচ বছর সংবাদ উপস্থাপক ও রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৯ সালে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে ইউরোপে যাওয়ার পর তিনি পড়াশোনা ও গবেষণার পাশাপাশি নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ইতালি, পর্তুগাল, ফ্রান্স, স্পেন এবং চেক প্রজাতন্ত্রসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। মাইগ্রেশন কনসার্নের সাথে তিনি কথা বলেছেন জার্মানিতে স্টুডেন্ট ভিসা, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জার্মানি যাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা; দেশটিতে থাকার সুযোগ-সুবিধা, দেশটিতে ইমিগ্রেশনের সম্ভাবনা, অপরচুনিটি কার্ডসহ নানা বিষয় নিয়ে। মাইগ্রেশন কনসার্নের পক্ষ থেকে তার সাথে কথা বলেছেন মাহবুব স্মারক। তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ প্রথম পর্ব। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন: মাফি, আপনাকে ধন‍্যবাদ মাইগ্রেশন কনসার্নকে সময় দেয়ার জন‍্য। আপনি জার্মানিতে আছেন, পড়াশোনা করছেন। পিএইচডি করছেন। এই যে জার্মানিতে আপনার থাকার অভিজ্ঞতা, তাতে কী মনে হচ্ছে জার্মানিতে কোন ধরনের স্টুডেন্ট বেশি যাচ্ছে বা যাওয়ার সুযোগ আছে বা কাজ বেশি পাচ্ছে। জার্মানিতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সুযোগ কেমন দেখছেন?

মাফি ইসলাম: আপনাকে ধন‍্যবাদ। জার্মানির ওভারঅল পরিবেশের চিন্তা করে যদি ছাত্রদের কনটেক্স থেকে বলি তাহলে বলব, জার্মানি দেশটা শিক্ষার্থীদের জন‍্য, পড়াশোনার জন‍্য একটা স্বর্গের মতো দেশ। আমি শুধু জার্মানিতেই না, ইউরোপের অন‍্যান‍্য দেশেও ঘুরেছি এবং এর আগে আমি সুইডেনে ছিলাম। সেখানেও পড়াশোনা করেছি। তো আমি খুব ভালো একটা তুলনা করতে পারি। জার্মানি যাওয়ার পর আমার মনে হয়েছে, আমি যদি আরেকটু রিসার্চ করে ইউরোপে পড়তে যেতাম, তাহলে ইউরোপের মধ‍্যে কেবল জার্মানির কথাই ভাবতাম। আমি অন‍্য কোনো দেশের কথা ভাবতাম না। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন: কী কারণে এমনটা মনে করছেন?

মাফি ইসলাম: এমনটা বলছি তার অনেক কারণ আছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, দেশটিতে পড়াশোনার জন‍্য কোনো টিউশন ফি নাই। বেশির ভাগ যে পাবলিক বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো আছে শিক্ষার্থীদের পড়তে কোন টিউশন ফি লাগে না । বরং মাঝে মাঝে যে কোনো সময়ে যে কোনো বিপর্যয়ের সময় সরকার সাপোর্ট দেয়। যেমন ধরেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ; কোভিডের সময়টায় ছাত্রছাত্রীদের পুরোপুরি সাপোর্ট দিয়েছিল জার্মান সরকার। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন: বিস্তারিত বলবেন, কোভিডের সময়টায় শিক্ষার্থীদের কী রকম সাপোর্ট দিয়েছিল জার্মান সরকার? 

মাফি ইসলাম: আমি তখন সুইডেনে ছিলাম। সুইডেনে যারা ইন্টারন‍্যাশনাল স্টুডেন্ট ছিল, তাদের জন‍্য কোনো ব্যবস্থাই ছিল না সুইডেন সরকারের পক্ষ থেকে। অর্থনৈতিক কোনো সাপোর্ট ছিল না। সেই সময় জার্মানিতে আমার যেসব বন্ধু ছিল, সেই সময়ে তারা ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা লোন পায় থাকা-খাওয়ার জন‍্য। লকডাউনের কারণে সেই সময়ে কিন্তু কারো চাকরি ছিল না। সেই সময় জার্মানির বেশির ভাগ ব্যাংক থেকে সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা ছিল যাতে ছাত্রছাত্রীদের একটা লোন দেয়, সাপোর্ট দেয়। সেই লোনটার তেমন কোনো ইন্টারেস্টও নাই। এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সেই লোন একটু একটু করে শোধ করছে। লোনটা বড় হলেও তার জীবনে বাড়তি তেমন কোনো চাপ ফেলছে না। তো এই একটা উদাহরণ দিয়ে কিন্তু বোঝা যায়, জার্মানির এনভায়রনমেন্টা কেমন। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, জার্মান সরকার তথা সার্বিকভাবে জার্মানি ইউরোপের অন‍্যান‍্য দেশের চেয়ে পড়াশোনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। আপনি জার্মানির ইতিহাস যদি দেখেন, বড় বড় যত সায়েন্টিস্ট আছে, ফিলোসফার আছে, লেখক আছে; আপনি দেখবেন, তারা জার্মান বংশোদ্ভূত। এটার একটা বড় কারণ বলে মনে হয়, তারা পড়াশোনার ওপর গুরুত্ব দেয়, রিসার্চের ওপর গুরুত্ব দেয়। তারপর দেশটি ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেয় এবং দেখবেন যেসব শহরে বড় বড় বিশ্ববিদ‍্যালয় আছে, সেসব শহরকে বলা হয় সায়েন্স সিটি। সেই শহরের যেসব স্টুডেন্ট আছে, তাদের সব সময়ই একটা অন‍্য চোখে দেখা হয়। ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয়। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন:  সে ক্ষেত্রে জার্মানির কোন সাবজেক্টে পড়াশোনায় বেশি আগ্রহ দেখায় বা ছেলেমেয়েরা পড়ে বা বাংলাদেশ থেকে পড়তে যাওয়ার জন‍্য ভালো বলে আপনি মনে করেন। শিক্ষার্থী যারা প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা ভাবনায় রাখতে পারেন?

মাফি ইসলাম: আমার দেখা এখন পর্যন্ত কম্পিউটার সায়েন্স, ইনফরমেশন কমিউনিকেশন টেকনোলজি; এই ডিসিপ্লিনের স্টুডেন্টরা বেশি ভালো করছে ওখানে। আর স্টুডেন্ট থাকা অবস্থাতেই জার্মানিতে চাকরি পাওয়া যায়। যেটাকে তারা বলে ভের্ক স্টুডেন্ট বা ওয়ার্কিং স্টুডেন্ট। তার মানে হচ্ছে, আপনি যেই সেক্টরেই পড়াশোনা করেন না কেন, সেই সেক্টরে যে জব ফিল্ড আছে; মনে করুন আপনি ব্যাংকিং সেক্টরে পড়াশোনা করছেন বা কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের এখন আপনি একটা ব্যাংকে কাজ করতে চান, তো আপনি স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় কাজ করতে পারবেন। সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা বা মাসে ৮০ ঘণ্টা আপনি কাজ করতে পারবেন একটা ব্যাংকের আন্ডারে। এতে করে আপনি প্র‍্যাকটিক‍্যাল যে এক্সপেরিয়েন্স সেটা পাচ্ছেন, আবার স্কুলে মানে ইউনিভার্সিটিতে এসে একাডেমিক যে স্টাডি, সেটার মাধ‍্যমে শিখছেন। ফলে আপনার লার্নিংটা দুই দিক থেকে হচ্ছে। হাতে-কলমে ও থিউরিটিক‍্যাল দুটি একসাথে। আপনার স্কিল না হয়ে উপায় নাই। আপনি রেডি হয়েই জব ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকছেন। পড়াশোনা শেষ করে আপনার বসে থাকতে হয় না। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন: সে ক্ষেত্রে কোন সেক্টরে পড়াশোনা করলে বেশি সুযোগ পাওয়া যায়?

মাফি ইসলাম: আমি বলব, আইসিটি ও কম্পিউটার সায়েন্স। এসব সাবজেক্ট সারা পৃথিবীতেই সবচেয়ে ডিমান্ডেবল ডিসিপ্লিন। এরপরে আছে নার্সিং, মেডিকেল সায়েন্স। সায়েন্স, টেকনোলজিও  মেডিকেলের ডিমান্ড অনেক বেশি। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন: কিন্তু শিক্ষার্থীদের জবের বিষয়ে জানতে চাই। তারা কেমন চাকরি করে বা পায় পড়াশোনার পরে বা পড়াশোনা চলাকালে?

মাফি ইসলাম: জবের কথা যদি বলি, জার্মানিতে পড়াশোনা ও জবের একটা ভালো ব‍্যালান্স থাকে। আমাদের প্রতিদিনকার যে জীবন, পড়াশোনা এবং কাজ প্রতিটি একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু আপনার কাছে চাপ কম মনে হবে। কারণ ছাত্র হিসেবে আপনি মাসে ৮০ ঘণ্টা কাজ করতে পারবেন। সেই ৮০ ঘণ্টায় আপনি যে টাকা ইনকাম করতে পারবেন, তা দিয়েই আপনি ভালোভাবে চলতে পারবেন। যদি আপনি সিঙ্গেল হন। তার মানে সপ্তাহে আপনি দুই দিন মাত্র কাজ করবেন। বাকি দিনগুলো আপনি পড়াশোনা করবেন। এই কারণে ইউরোপের অন‍্যান‍্য দেশে যে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে যায়, তারা দেখবেন ঝরে যায়। পড়াশোনা শেষ করতে পারে না। অল্প কিছু দিন পড়াশোনার পর কাজে চলে যায়। কাজের ভিসার দিকে তাদের নজর থাকে। কিন্তু জার্মানিতে যারা আসে, তারা চেষ্টা করে দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি সর্বোচ্চ তিন বা চার বছরের মধ‍্যে, অনেকে পাঁচ বছর লাগলেও তারা তা শেষ করে। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে। এই সুযোগটা জার্মানিতে আছে। আপনাকে বাড়তি কোনো প্রেশার দিবে না যে, তোমার দুই বছরের ডিগ্রি তোমাকে দুই বছরেই শেষ করতে হবে। হয়তো দু-একটা বিশ্ববিদ‍্যালয়ে কিছু রেস্ট্রিকশন থাকে। তবে অতো কড়াকড়ি না।ওরা বরং শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেয়, তুমি পড়াশোনা করতে আসছ, তুমি পড়াশোনাটা করো। এতে বোঝা যায়, জার্মানি কতটা স্টুডেন্টফ্রেন্ডলি একটা দেশ। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন:  সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীদের মনের ভেতর যদি এমন চিন্তা থাকে যে, তারা পড়াশোনা শেষ করে নাগরিকত্ব নেবে, সেটার প্ল‍্যান হওয়া উচিত?

মাফি ইসলাম: দুই ভাগে যাওয়া যায়। একটা হলো স্টুডেন্ট হিসেবে যাওয়া। স্টুডেন্ট হিসেবে যদি আপনি জার্মানিতে যান, তাহলে নাগরিকত্বের বিষয়টি বেশি সহজ। আপনার যদি পড়াশোনায় জার্মান ডিগ্রি থাকে, অন‍্যদের যদি ৫ বছর সময় লাগে তাহলে আপনার লাগবে ৩ বছর। অন‍্যদের যদি পিআর পেতে লাগে ৪ বছর, তাহলে ডিগ্রির কারণে আপনার লাগবে ২ বছর। পিআর পেতে গেলে দেশটির ভাষা মানে জার্মান ভাষা জানতে হবে বি ওয়ান পর্যন্ত। আর ওদের রেনেভার মানে পেনশন বলে ওরা; পেনশনের যে ইন্স্যুরেন্স, সেটা ২৪ মাস আপনাকে দিতে। এর এনশিউর করতে পারলে, দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি থাকে, ইন্স্যুরেন্স দেড় বছর পে করে থাকেন, যদি জব থাকে, তাহলে ইজিলি আপনার পিআর পেয়ে যাবেন। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন:  জার্মানিতে যেতে হলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কোন কোন প্রস্তুতি নিতে হবে সবার আগে?

মাফি ইসলাম: সবার আগে নিতে হবে ভাষার প্রস্তুতি। তাতে জোর দেয়া দরকার। যদিও মাস্টার্স লেভেলে পড়াশোনা করতে গেলে, ভাষা খুব একটা দরকার হয় না। কারণ মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন  হলো ইংলিশ। মানে পড়াশোনার মিডিয়ান ইংলিশই হয়। কিন্তু সার্বিকভাবে জার্মান সোসাইটির সাথে ইন্টিগ্রেশনের জন‍্য জার্মান ভাষা আপনাকে জানতেই হবে। ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি কারো আল্টিমেট টার্গেট হয় পিআর পাওয়া, মানে জার্মানিতে সেটেল্ড করা, সে ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ‍্যই জার্মান ভাষা শিখতেই হবে। সে ক্ষেত্রে আমার মতামত হচ্ছে, বাংলাদেশের স্টুডেন্টরা জার্মানির কথা যদি বিবেচনা করে পড়াশোনার জন‍্য। তাহলে ভাষা শিখতে শুরু করতে পারে এখন থেকেই। যদিও স্টুডেন্টদের লম্বা একটা সময় অপেক্ষা করা লাগছে ভিসা পেতে দূতাবাসে। তাই এই সময়টা কিন্তু কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন আমি দূতাবাসে আবেদন করলাম, দুই বছর লাগবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে, তো এই দুই বছর জার্মান ভাষাটা শিখে ফেলতে পারি। একদম আপ টু দ্য মার্ক করে ফেলতে পারি। তাহলে কিন্তু দুই বছরে ভাষাটা নেইটিভ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। সেভাবেই পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। 

চলবে…

Logo