Logo
×

Follow Us

মতামত

মোহাম্মদ আবুল বশির, মতামত পর্ব ১

তিন মাসের ইকামায় সৌদিতে বেকার কর্মীরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ২৩:১০

তিন মাসের ইকামায় সৌদিতে বেকার কর্মীরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে
মোহাম্মদ আবুল বশির, বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল আরটিভির সৌদি ব্যুরো চিফ। সৌদি আরবে প্রবাসী সাংবাদিক ফোরামের সাবেক সভাপতি। সৌদি আরবের রিয়াদে সাংবাদিকতা করেন প্রায় ৩৫ বছর ধরে। ১৯৯১ সালে সৌদি আরব যান। সেখানে তিনি দৈনিক খবর পত্রিকার ব্যুরো চিফ হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। মাইগ্রেশন কনসার্নের পক্ষ থেকে মাহবুব স্মারক কথা বলেছেন আবুল বশিরের সাথে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: আবুল বশির আপনাকে স্বাগতম। আপনার কাছে জানতে চাই, বর্তমানে কত বাংলাদেশি প্রবাসী আছেন সৌদি আরবে?
মোহাম্মদ আবুল বশির: আপনাকে ধন‍্যবাদ। সৌদি আরবে বর্তমানে ৩২ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন: বাংলাদেশিদের চেয়ে বেশি অন‍্য কোন দেশের কর্মীরা কাজ করছেন সৌদি আরবে?
মোহাম্মদ আবুল বশির: বাংলাদেশিদের থেকে বেশি আর কোনো দেশের শ্রমিক এ দেশে কাজ করেন বলে আমার জানা নেই। বাংলাদেশিরাই সবচেয়ে বেশি এই দেশে।

মাইগ্রেশন কনসার্ন : বর্তমানে সৌদি আরবের যিনি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমান, তিনি ভিশন ২০৩০ নামে একটি মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এ লক্ষ্যে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে সৌদি আরবে। আমাদের দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক কর্মী সৌদি আরব যাচ্ছেন কাজের জন্য। এত সংখ্যক শ্রমিক, সবাই কি ভালো আছেন? 
মোহাম্মদ আবুল বশির: ২০৩০ সালকে সামনে রেখে মুহাম্মাদ বিন সালমান সৌদি আরবকে রীতিমতো ঢেলে সাজাচ্ছেন বলা যেতে পারে। এ দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এখন আকাশচুম্বী। তিনি চাচ্ছেন, সৌদি আরবের যে পর্যটন খাত আছে, এ খাতকে বিকশিত করে সারাবিশ্বের কাছে একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে। আপনি বলেছেন, প্রচুর বাংলাদেশি এখানে এসেছেন এবং আসছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যার কথা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অনেকেই বেকার এখানে। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন: কর্মীরা কেন বেকার হচ্ছেন?
মোহাম্মদ আবুল বশির: বেকার হওয়ার কারণ, যারা বাংলাদেশে থেকে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে আসছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই মাত্র তিন মাসের ইকামা নিয়ে আসছেন এবং এই বাংলাদেশিরাই সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়ছেন। আপনাকে বলে রাখি, যেসব কর্মী সৌদি আরবে আসেন, তাদের কাজ পেতে কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু মাত্র তিন মাসের কাজের ভিসা নিয়ে যারা আসছেন, তাদের তো কাজ খুঁজে পেতেই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারাই বিপদে পড়ে যাচ্ছেন। ফলে প্রচুর বেকার বাংলাদেশিকে দেখা যাচ্ছে এখন।

মাইগ্রেশন কনসার্ন: কিন্তু যারা দক্ষ কর্মী, তারাও কি বেকার থাকছেন? 
মোহাম্মদ আবুল বশির: যারা কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে সৌদি আরবে আসছেন, তারা কিন্তু কেউই বেকার নন। তাদের কাজের অভাব নেই। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন: আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন, মাত্র তিন মাসের ইকামা নিয়ে যেই কর্মী বা শ্রমিক ভাই গেছেন, তিন মাস তো খুবই সংক্ষিপ্ত সময়, এর পর তাদের নিয়ে কোনো কর্তৃপক্ষ, আমাদের দূতাবাস বা যে এজেন্সির মাধ্যমে তারা গেছেন, তারা কি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে বা নিয়েছে?
মোহাম্মদ আবুল বশির: আমরা যারা সৌদি আরবে সাংবাদিকতা করি, আমাদের কাছে এ রকম অসংখ্য কর্মী বা শ্রমিক আসছেন, তাদের সমস্যার কথা বলছেন। তিন মাসের ইকামার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তারা বেকার হয়ে যাচ্ছেন, তাদের কাজ জুটছে না। তাদের অনেকেই না খেয়ে থাকছেন, দেশে ফিরে যেতে চাচ্ছেন। এই কর্মীরা বেশির ভাগই হয় সুদের ওপর ধার করে, কেউ ব্যাংকের লোন নিয়ে এ দেশে এসেছেন। এখন কাজ নেই, মাথায় ঋণের বোঝা, পরিবারের চাপ– সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশই ভীষণ বিপদে আছেন।  
আপনাদের কাছে কোনো তথ্য আছে কিনা জানি না, এখানে অনেক মানুষ কিন্তু এসব চাপেই স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে আমরা সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখলাম, অনেক মানুষ দেশে ফিরে যেতে চাইছেন, কিন্তু সেটাও পারছেন না। দূতাবাসে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ভিড় করছেন। সে কারণে দূতাবাসের নিয়মিত কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিচ্ছে। বেকার কর্মীদের কাজ নেই, ইকামা নেই, ভিসার মেয়াদ শেষ; টাকা নেই, খাবার কেনার টাকা নেই, অনেকে অসুস্থ; এমনকি কেউ মারা গেলে লাশ পাঠানোটাও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার আগে যেখানে একটি লাশ পাঠাতে ৮০০-১০০০ রিয়াল প্রয়োজন হতো, বর্তমানে সে খরচ হয়েছে ১৩ হাজার রিয়াল। একজন শ্রমিক মাসে বেতন পায় ৮০০ থেকে ১২০০ রিয়াল। সে মারা গেলে তার লাশ পাঠাতে লাগবে ১৩ হাজার রিয়াল। এ খরচটা কে করবে? অনেকে দেশের বাড়ি থেকে টাকা আনিয়ে লাশ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। অনেকের ক্ষেত্রে প্রবাসীরা চাঁদা তুলে সেই ব্যবস্থা করে। আমরা যখন শুনি, প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে শক্তিশালী হচ্ছে দেশ, আর প্রবাসীদের লাশ পাঠাতে তুলতে হচ্ছে চাঁদা, তখন আমরা লজ্জিত হই, আশাহত হই। 

মাইগ্রেশন কনসার্ন: এই সমস্যা সমাধানে কী করা উচিত বলে আপনার পরামর্শ?
মোহাম্মদ আবুল বশির: আমি মনে করি, প্রবাসীদের এই দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের যৌথভাবে কাজ করা উচিত। প্রবাসীদের এই সমস্যগুলোর আশু সমাধান নিশ্চিত করা দরকার।

মাইগ্রেশন কনসার্ন: যে গুরুতর সমস্যাটির কথা আপনি বললেন, মাত্র তিন মাসের ইকামা নিয়ে সৌদি আরব যাচ্ছেন আমাদের কর্মীরা, ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কাজ না পেয়ে বেকার হচ্ছেন, এটা কি সৌদি আরবের সব শহরেই একই চিত্র?
মোহাম্মদ আবুল বশির: এটা পুরো সৌদি আরবেরই চিত্র। বেকারত্ব যেমন বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি আপনি শুনে অবাক হবেন, কিছু বাংলাদেশি অপরাধ কার্যক্রমে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিছু দুষ্কৃতিকারী কিডন্যাপিংয়ের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের অনেকেই দূতাবাসে এ বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছে। আপনাকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এখানে যদি অল্প কিছু লোকের জন্য পুরো বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে কিন্তু পুরো বাংলাদেশই এর ফল ভোগ করবে। পুরো জাতির বদমান হবে, দেশের বদনাম হবে। তাই দূতাবাসের উচিত এ বিষয়গুলো কঠোরভাবে মনিটর করা।

মাইগ্রেশন কনসার্ন: আবুল বশির, নতুন কর্মীদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনটা বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ আবুল বশির: এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তিন মাসের ইকামা। সৌদি আরবের আইন যথেষ্ট কড়া এবং এই মুহূর্তে তারা কঠোরভাবে সবার কার্যক্রম মনিটর করছে। ফলে অবৈধ হয়ে সৌদি আরবে কোনো কাজ করা রীতিমতো অসম্ভব। তাই যারাই সৌদি আরবে আসতে চান, অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি ইকামা নিয়ে আসবেন, কাজের নিশ্চয়তা নিয়ে আসবেন এবং অবশ্যই প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে আসবেন।

মাইগ্রেশন কনসার্ন: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, তিন মাসের ইকামা নিয়ে কারো বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া উচিত হবে না?
মোহাম্মদ আবুল বশির: অবশ্যই উচিত হবে না। এখানে যারা আসছেন, তারা তাদের আত্মীয়স্বজনের ওপর নির্ভর করে আসছেন। ভাবছেন, কিছু না কিছু হয়ে যাবে। তার পরিচিতজনরা ইকামা পরিবর্তন করে দিতে পারবেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এটা করা সম্ভব না। ফলে আজকের এই প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। অনেকেই আমাকে ফোন করে বলছেন, দেশে ফিরে যাবে, এখানে কাজ নেই, অর্থ নেই। আমাদের দূতাবাসও এই সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম আপগ্রেডেশনের কাজ চলছে, এর মধ্যে এই সমস্যা। সবকিছু মিলিয়ে সৌদি আরবের পরিস্থিতি ভালো নয়। যারা আসবেন, তারা যেন ন্যূনতম এক বছরের ইকামা নিয়ে আসেন। কারণ এক বছরের মধ্যে কোথাও না কোথাও কাজের সন্ধান পাওয়া যায়, আত্মীয়রস্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা একটা ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু মাত্র তিন মাসের ইকামায় সেটা সম্ভব নয়। 

চলবে…

Logo