ঢেলে সাজানো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর
থাকবে না গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ব্যুরো

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৯

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের খসড়া এক নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে করে আফ্রিকায় চলা প্রায় সব কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়া এবং এই মহাদেশে থাকা দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
খসড়া নির্বাহী আদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও শরণার্থী নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে কাজ করা দপ্তরগুলোর পাশাপাশি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা দপ্তরগুলোও বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে।
এ সপ্তাহে এই নির্বাহী আদেশে সই করতে পারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে শৃঙ্খলা ফেরানো, অর্থের অপচয় বন্ধ করা, জালিয়াতি ও অপব্যবহার কমিয়ে এর কাজের প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করা নির্বাহী আদেশটির লক্ষ্য।আগামী ১ অক্টোবর নাগাদ পররাষ্ট্র দপ্তর এই পরিবর্তন আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, এই পরিকল্পনার বিষয়ে জানাশোনা আছে এমন কয়েকজন সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, নির্বাহী আদেশটি সইয়ের পাশাপাশি পররাষ্ট্র কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত পেশাদার কূটনীতিক এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদেরও ছাঁটাইয়ের চেষ্টা করা হবে। এসব কর্মকর্তা সাধারণত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়াশিংটন সদর দপ্তরে কাজ করে থাকেন। এই মন্ত্রণালয় বিপুলসংখ্যক কর্মীকে বেতনসহ ছুটিতে পাঠানো এবং বরখাস্তের নোটিশ পাঠানো শুরু করতে পারে বলেও সাবেক এই মার্কিন কর্মকর্তারা জানান।
খসড়া নির্বাহী আদেশে নিয়োগপ্রত্যাশী কূটনীতিকদের পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়োগের পরীক্ষা নেওয়া বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে মতের মিল থাকা’- এ ধরনের নতুন কিছু মানদণ্ড ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
খসড়া আদেশে বলা হয়েছে, নথিপত্র তৈরিতে সাহায্য করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার অবশ্যই ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। ‘নীতি প্রণয়ন ও পর্যালোচনা এবং বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা’ গ্রহণ করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট সই করার আগে নির্বাহী আদেশের বিষয়বস্তুতে পরিবর্তনও আসতে পারে। গতকাল রোববার দিনের শুরুতে তাৎক্ষণিক এই নির্বাহী আদেশের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি পররাষ্ট্র দপ্তর কিংবা হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদ।
প্রস্তাবিত এই পুনর্গঠন বাস্তবায়িত হলে বিশ্বের বড় একটি অংশে নীতি গ্রহণ ও প্রণয়নে যুক্ত আঞ্চলিক ব্যুরোগুলো আর থাকবে না। এর পরিবর্তে এখন থেকে চারটি উপবিভাগের অধীনে এই ব্যুরোগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
উপবিভাগগুলোর মধ্যে ‘ইউরেশিয়া’ ইউরোপ, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া নিয়ে গঠিত। ‘মিড-ইস্ট’ উপবিভাগের অধীনে পড়েছে আরব দেশগুলো এবং ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। ‘লাতিন আমেরিকা’ উপবিভাগে পড়েছে মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ উপবিভাগ পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ সম্পর্কিত বিষয়গুলো দেখভাল করবে।
সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি হলো আফ্রিকা মহাদেশ সম্পর্কিত ব্যুরো বাদ দেওয়া। এটি সাব-সাহারা আফ্রিকা সম্পর্কিত নীতি দেখভাল করে থাকে। এর পরিবর্তে অনেক ছোট পরিসরে গঠিত বিশেষ দূতের দপ্তর আফ্রিকা সম্পর্কিত বিষয়গুলো দেখবে। এই দপ্তর হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদের অধীনে কাজ করবে। ‘সমন্বিত সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের’ মতো হাতেগোনা কিছু বিষয়ের ওপর এই দপ্তর জোর দেবে।
খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, সাব-সাহারা আফ্রিকায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমন দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলো আগামী ১ অক্টোবরের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এতে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট এবং দেশের স্বার্থের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সংগতি রেখেই আফ্রিকায় কূটনীতিক পাঠানো হবে।
নির্বাহী আদেশের খসড়া অনুযায়ী, কানাডা সম্পর্কিত কার্যক্রম নবগঠিত নর্থ আমেরিকাবিষয়ক দপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর অধীনে কাজ করবে। এই দপ্তর অনেক কম লোক দিয়ে পরিচালিত হবে। এছাড়া অটোয়ায় মার্কিন দূতাবাসের কাজের পরিসর ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনবে পররাষ্ট্র দপ্তর।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যুরো বিলুপ্ত করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাদ পড়বে শরণার্থী ও অভিবাসনের বিষয়টি দেখভাল করা এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে কাজ করা ব্যুরোও। প্রথম দুটি ব্যুরোর আন্ডার সেক্রেটারি পদ বাদ দেওয়া হবে। একইভাবে বাদ পড়বে পাবলিক ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্স দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি পদও।
খসড়া আদেশ অনুযায়ী, ‘আন্ডার সেক্রেটারি ফর ট্রান্সন্যাশনাল থ্রেট এলিমিনেশন’ নামে নতুন একটি জ্যেষ্ঠ পদ তৈরি করতে যাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই দপ্তর মাদকবিরোরোধী নীতি এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখভাল করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা- ইউএসএআইডির অবশিষ্ট অংশের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে মানবিক সহায়তাবিষয়ক ব্যুরো। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও এবং ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তার হাতে এই সংস্থা (ইউএসএআইডি) রীতিমতো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
কর্মীদের প্রসঙ্গে খসড়া নথিতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিকভাবে পালাক্রমে দায়িত্ব পালনের এখনকার সেকেলে ও বিশৃঙ্খল প্রথা থেকে বের হয়ে দক্ষতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরো দক্ষ, পরিকল্পিত ও আঞ্চলিক বিশেষায়িত চাকরিকাঠামোর দিকে অগ্রসর হতে হবে। এর মানে হলো, পররাষ্ট্র বিভাগে চাকরিপ্রত্যাশীদের আবেদনের সময় উল্লেখ করতে হবে, তারা কোন আঞ্চলিক উপবিভাগে কাজ করতে চান।
খসড়ায় বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র বিভাগ ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থের বিনিময়ে স্বেচ্ছায় অবসর বা পদত্যাগের প্রস্তাব দেবে পররাষ্ট্র দপ্তর।
এই নির্বাহী আদেশের খসড়ায় ফুলব্রাইট বৃত্তির অধীনে অধ্যয়নের ক্ষেত্র সীমিত করতে বলা হয়েছে, যাতে জাতীয় নিরাপত্তার মতো বিষয় নিয়ে মাস্টার্স পর্যায়ে অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থীদের কেবল এই সুবিধা দেওয়া যায়।
খসড়া নথিতে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র দপ্তর হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করবে। ফলে ঐতিহাসিকভাবে এই কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠানটি র্যাঞ্জেল অ্যান্ড পিকারিং বৃত্তির জন্য প্রার্থী নির্বাচনের সুযোগ হারাতে যাচ্ছে। এই বৃত্তির লক্ষ্য ছিল স্নাতক শেষের পরই সমাজের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের পররাষ্ট্র বিভাগে প্রবেশে সহায়তা করা।
পররাষ্ট্র দপ্তরে পরিবর্তন আনার বিভিন্ন প্রস্তাবসংবলিত কয়েকটি অভ্যন্তরীণ নথি সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে এই খসড়া নির্বাহী আদেশ একটি। আরেকটি নথিতে এই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ আগামী অর্থবছরে প্রায় ৫০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি অভ্যন্তরীণ নথিতে ১০টি দূতাবাস এবং ১৭টি কনস্যুলেট বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
কাবেরী মৈত্রেয়, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র