
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমানো বহু তরুণ আজ ‘টারজান ভিসা’ নামক এক প্রতারণার শিকার। কাগজে-কলমে এই ভিসার কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু বাস্তবে এটি মানব পাচারের এক ভয়াবহ রুটিন পদ্ধতি। দালালচক্রের মাধ্যমে এক দেশ থেকে আরেক দেশে, কখনো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, কখনো সমুদ্রপথে, আবার কখনো পাহাড় বা মরুভূমি পেরিয়ে এই ভিসায় মানুষকে পাচার করা হয়।
টারজান ভিসার নামকরণ এসেছে জনপ্রিয় চরিত্র ‘টারজান’-এর মতো এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে চলার ধারণা থেকে। মানব পাচারকারীরা ঠিক তেমনভাবেই একাধিক দেশ ঘুরিয়ে, ভাঙা ভিসা বা জাল কাগজে মানুষকে ইউরোপে পাঠানোর চেষ্টা করে। এই ভিসায় ভুক্তভোগীরা কখনো জর্ডান, মিসর, লিবিয়া হয়ে ইতালির সীমান্তে পৌঁছান; আবার কেউ তুরস্ক, গ্রিস, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়ার বন-জঙ্গল পেরিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন।
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান জানান, নব্বইয়ের দশকে থাইল্যান্ডের জঙ্গল দিয়ে, ২০১৫ সালে সমুদ্রপথে ‘ডলফিন ভিসা’ নামে, আর এখন ‘টারজান ভিসা’য় মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে মানব পাচার হচ্ছে। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী এই ধরনের ভিসায় বিদেশে গিয়েছেন, যাদের অনেকেই বৈধভাবে অর্থ পাঠাতে পারেন না, কারণ তারা নিজেই ‘আনডকুমেন্টেড’।
এই পাচারের সবচেয়ে সক্রিয় রুট হলো কোর রুট, যেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ যেমন ওমান, সৌদি আরব বা জর্ডানে পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকে আফ্রিকার লিবিয়া, মিসর হয়ে ইউরোপের সীমান্তে পৌঁছানো হয়। এই রুটে মানব পাচারকারীরা প্লাস্টিকের নৌকা, ট্রাকের খোল, এমনকি পায়ে হেঁটে মানুষকে সীমান্তে পৌঁছায়। অনেক সময় তারা বন-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। যেমন বসনিয়ার মিরাল ক্যাম্পে দেখা গেছে শত শত বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে অনেকে দালালকে ১০-১২ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটক হয়ে জেলে যেতে হয়েছে বা দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। এই ভিসায় কোনো কাজের নিশ্চয়তা নেই, বরং রয়েছে ভয়াবহ দুর্ভোগ, নিঃস্ব পরিবার এবং মানসিক বিপর্যয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের মানব পাচার রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং জনসচেতনতা জরুরি। তরুণদের উচিত যাচাই না করে দালালের প্রলোভনে না পড়া এবং বৈধ পথে অভিবাসনের চেষ্টা করা।
তথ্যসূত্র: ডয়েচে ভেলে