ম্যারাডোনা: এক অভিবাসী যেভাবে নাপোলির ঈশ্বর হয়ে গেলেন
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৭
যে শহর জন্ম নেওয়া ছিল ইতিহাসের ধুলার নিচে, যেখানে তেমন কোনো পালকই ছিল না যে আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন বয়ে নিয়ে যেত; নাপোলি সেই শহর। গৃহযুদ্ধের কালো দাগ, দারিদ্র্যের কড়া বাস্তব, রাষ্ট্রের অবহেলা ও অপরাধ গোষ্ঠীর নীরব শাসন; এগুলোই ছিল নাপোলির দৈনন্দিন জীবন। তখন এসেছে এক আর্জেন্টাইন তরুণ; দিয়াগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। আর সঙ্গে এনেছেন এক অনিবার্য সাক্ষাৎ, যা শহরকে বদলে দিল।
বার্সেলোনার উজ্জ্বল আলো থেকে নাপোলির অপরাধ ও উপেক্ষার শহরে আসা; ম্যারাডোনার সেই পদক্ষেপ ছিল ফুটবল বিশ্বের জন্য এক অভাবনীয় বিস্ময়। তখন তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ তারকাদের একজন; বার্সেলোনা-আর্জেন্টিনায় সে নাম সামনে; তবু যখন তিনি নাপোলিতে পা দিলেন, নাপোলি ছিল খোঁচা, অনাদর আর হতাশার শহর; সেখানে একজন বিদেশি কীভাবে বদলে দিতে পারবে মানুষের মন-প্রাণ, তা কেউ কল্পনাও করত না।
মাঠে ম্যারাডোনা কেবল গোল করার খেলোয়াড় ছিলেন না; তিনি ছিলেন আশা। প্রতিটি ড্রিবল, প্রতিটি পাস, প্রতিটি গোল ছিল নাপোলির মানুষের জন্য এক কণ্ঠস্বর- তোমরা মূল্যবান, তোমাদের মর্যাদা আছে। স্টেডিয়ামে তার জার্সি দেখলেই গৃহহীন, দরিদ্র ও উপেক্ষিত মানুষ যেন নতুন করে শ্বাস নিত। তিনি তাদের যেন বললেন, এই শহর তোমাদের, তোমার গর্ব ফিরবে।
নাপোলির পিচে তিনি করে দেখালেন এমন কিছু, যা কেবল খেলায় নয়; তা ছিল আত্মবিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন। একটি শহর যেখানে অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে অদৃশ, অবহেলিত, অপরাধ-জোনের আড়ালে চাপা পড়ে ছিল, সেখানে ম্যারাডোনা একটি আলোকস্তম্ভ হয়ে উঠলেন। তার খেলার জোরে লোকেরা রাস্তায় ফিরল, কফির হাউসগুলো আবার জীবন্ত হলো, ছোটদের হাসি ফিরে এলো। যারা আগে ঘুম ভেঙে ভয়ে ছিল, তারা এখন স্টেডিয়ামে গানের মধ্যে মিলন পেল।
ম্যারাডোনা নিজে ত্রুটিপূর্ণ মানুষ ছিলেন; নেশা, সীমাবদ্ধতা, ব্যক্তিগত ঝামেলা ছিল। তবু নাপোলির কাছে তিনি ভুল-ত্রুটিযুক্ত হলেও পবিত্র ছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন একজন অভিবাসী, যে তাদের সঙ্গে দাঁড়ালেন, তাদের কষ্ট বুঝলেন, তাদের কাঁধে হাত রাখলেন এবং বললেন- তোমাদেরও গর্ব আছে। একপাক্ষিক না, নাপোলির জনগণ তাকে নিজের করে নিয়েছিল; সে হয়ে উঠল Saint Diego, যা একটি পৌরাণিক, মানবিক প্রতীক।
তার খেলা ও ব্যক্তিত্ব নাপোলির অপরাধ ও হতাশার অন্ধকারকে হালকা করে দিল। স্ট্রিট কিডদের জন্য ফুটবলই একটি আশ্রয় হয়ে উঠল। শহরের মোড়লরা রাজনীতি বা প্রশাসন বদলাতে পারেনি, কিন্তু তাদের মুখে ম্যারাডোনার নাম বললে একরকম সম্মান ফিরে এলো। তিনি দেখালেন, ক্রীড়া একটি শহরের আত্মাকে কেমন করে জাগিয়ে দিতে পারে।
আজ ম্যারাডোনার মৃত্যুর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল। সময় কেটে গেলেও নাপোলির মানুষের মনে তার অভাব আজও আগের মতো তীব্র। তার স্মৃতি সেখানে শুধু একটি খেলোয়াড়ের অতীত নয়; কষ্ট, গর্ব, আশার একটি জ্বলন্ত অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে।
লোকেরা বলত, ম্যারাডোনা আমাদের মধ্যে একজন। তিনি বিদেশি ছিলেন, অভিবাসী ছিলেন, তবু তিনি নাপোলির কষ্ট বুঝতেন। রাজনীতি ব্যর্থ হলে, প্রশাসন নীরব হলে, ম্যারাডোনা বলতেন- আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। তিনি গর্ব ফিরিয়ে দিলেন, মানুষের ইচ্ছা-বল জাগিয়ে দিলেন। স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ কেবল ফুটবল দেখত না, তারা দেখত জীবন যে হতে পারে অন্যরকম মর্যাদাপূর্ণ, প্রত্যাশাময়।
আজও যদি কোনো ছেলে রাস্তায় বল নিয়ে দৌড়ে ওঠে, কোনো মা যদি বাজার থেকে ফিরে এসে জার্সি খুলে ঝুলিয়ে রাখে, তা হলে জানবেন ম্যারাডোনার স্মৃতি নাপোলির প্রতিটি কোণে বেঁচে আছে। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু তার দেওয়া গর্ব আর আশা সেই শহরের মানুষের মধ্যে অম্লান থেকে যাবে।
logo-1-1740906910.png)