
২০২৪ সালে ইউরোপে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর হার ৫২ শতাংশ কমেছে আগের বছরের তুলনায়। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বলকান ও নন-শেনজেন দেশগুলোতে গিয়ে অনেকে কাজ ছেড়ে দিয়ে অবৈধভাবে শেনজেনভুক্ত দেশে চলে যাচ্ছেন। এতে ইউরোপীয় নিয়োগদাতাদের মধ্যে বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়ে অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
ইউরোপজুড়ে কর্মী চাহিদা বাড়লেও বিশেষ করে রোমানিয়া, পোল্যান্ড, মাল্টা, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও আলবেনিয়ার নিয়োগকারীরা এখন বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহী নন। অভিবাসন বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি এবং ইউরোপমুখী অভিবাসীদের জন্য কঠোর ভিসা নীতির কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অথচ গত পাঁচ বছর ধরেই ইউরোপে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ধীরে ধীরে বাড়ছিল।
২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের হেগ দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, ক্রোয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, বাংলাদেশি কর্মীরা সে দেশের ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে অন্য শেনজেন দেশে চলে যাচ্ছে। ফলে দেশটি বাংলাদেশিদের জন্য ওয়ার্ক পারমিট সাময়িক স্থগিত করার কথা ভাবছে।
রিক্রুটাররা বলছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ইউরোপে বাংলাদেশের সীমিত শ্রমবাজারও হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইন ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ায় বাংলাদেশ যখন নতুন বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে, তার মধ্যে ইউরোপে এই ধস নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
ইউরোপে কর্মী প্রেরণকারী ইনফিনিটি এইচসিএম লিমিটেডের চেয়ারম্যান শারমিন আফরোজ সুমি বলেন, "রোমানিয়া ও বসনিয়ার মতো দেশে আমরা কর্মী পাঠালেও সেখানে গিয়ে অনেকেই পরে পালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু আড়াই বছরে রোমানিয়ায় ২ হাজার কর্মী পাঠালেও তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দেশটি ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে গেছে।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশি কর্মীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে এসব দেশের নিয়োগকর্তাদের থেকে চুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।" এতে ইউরোপে বাংলাদেশি কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করে সুমি জানান, তার কোম্পানি বর্তমানে ভারত, কিরগিজস্তান ও নেপালের মতো দেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ শুরু করেছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর ২০২৪ সালে ইউরোপে বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগে খাড়া পতন হয় ২০২৪ সালে। আগের বছর যেখানে ৪৬ হাজার ৪৫৫ জন কর্মী ইউরোপ যান, ২০২৪ সালে তা নেমে আসে মাত্র ২২ হাজার ২৭১ জনে।
ক্রোয়েশিয়ার ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহারে অনিয়ম
২০২৪ সালে ক্রোয়েশিয়া বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ১২ হাজার ৪০০টি ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করলেও ৮ হাজার জন কখনোই দেশটিতে যাননি। আর যারা গেছেন, তাদের মধ্যে মাত্র অর্ধেক বর্তমানে চাকরিতে রয়েছেন।
ইউরোপীয় অভিবাসন বিশেষজ্ঞ রিফাত মাহমুদ জানান, জানুয়ারি থেকে ক্রোয়েশিয়া প্রায় ৫০ হাজার চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনও প্রস্তাব পায়নি, বরং ভারত ও নেপাল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রস্তাব পেয়েছে।
ইউরোপের শ্রম বাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি বড় প্রতিবন্ধকতা
বিএমইটির তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ৪২ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে পাঠালেও এর মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ ইউরোপে নিয়োগ পেয়েছে।
বাংলাদেশি দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি ও ইউরোপগামী কর্মীদের জন্য কঠোর ভিসা বিধিনিষেধ- এই দুই কারণে ইউরোপের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে বলে মনে করছেন অভিবাসন খাতের বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, বৈধ অভিবাসনের সুযোগ থাকলেও তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে না পারায় ইউরোপে যেতে হাজার হাজার বাংলাদেশি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিয়মিত পথে পাড়ি জমাচ্ছেন।
বয়স্ক জনগোষ্ঠী ও শ্রমবাজার সংকটে ভোগা ইউরোপের অনেক দেশেই কর্মী চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে বলকান ও নন-শেনজেন দেশগুলো এখনো বাংলাদেশি কর্মী নিতে আগ্রহী, তবে সেসব দেশের নিয়োগদাতারা এখন বিশেষায়িত দক্ষ শ্রমিক চাচ্ছেন। কম দক্ষ কাজের ক্ষেত্র যেমন নির্মাণ, মালামাল লোডিং-আনলোডিংয়ে কর্মী প্রয়োজন থাকলেও সেগুলোর চাহিদা কমে এসেছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ এই কর্মী চাহিদার কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারবে, যদি দক্ষতার ঘাটতির সমাধান এবং অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলা যায়।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ১৮২টি দেশে কর্মী পাঠিয়েছে, যার মধ্যে ৪২টি ইউরোপীয় দেশ বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ করেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬ হাজার ৩৩৩ জন নিয়েছে ইতালি। এরপর রয়েছে রোমানিয়া, যুক্তরাজ্য, ক্রোয়েশিয়া, মাল্টা, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, আলবেনিয়া ও রাশিয়া।
ঢাকায় দূতাবাসের না থাকার সমস্যা
ঢাকায় ইউরোপের অনেক দেশের দূতাবাস বা ভিসা সেন্টার নেই, ফলে ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জন্য জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) নেতারা জানান, অস্ট্রিয়া, সুইডেন ও ডেনমার্ক ইতোমধ্যে ভিসা সেন্টার চালু করছে। তবে বলকান ও নন-শেনজেন দেশগামী কর্মীদের ভিসার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি এখনো কঠিন।
ফলে অনেক বাংলাদেশি কর্মীকেই ভারত গিয়ে ভিসার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত বাংলাদেশিদের ভিসা দেয়া কঠিন করে দিয়েছে, ফলে সমস্যা আরো বেড়েছে।
কম কর্মী নিয়োগের পরও ইউরোপ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী
তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় কম হলেও ইউরোপে থাকা বাংলাদেশি কর্মীরা মধ্যপ্রাচ্যের প্রচলিত কিছু গন্তব্যের চেয়ে অনেক বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। চলতি অর্থবছরে শীর্ষ ৩০টি রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশের মধ্যে ইউরোপের ৯টি দেশ রয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইউরোপের শীর্ষ প্রবাসী আয়ের উৎস হিসেবে রয়েছে যুক্তরাজ্য, যা রেমিট্যান্সের উৎসগুলোর মধ্যে সামগ্রিকভাবে চতুর্থ অবস্থানে। দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭৭ কোটি ডলার। অনানুষ্ঠানিক হিসাবমতে, আনুমানিক ৭ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। এরপর রয়েছে ইতালি, যেখান থেকে এসেছে ১০২ কোটি ডলার।
তথ্যসূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড