রেমিট্যান্স কীভাবে সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৪
বিদেশে থাকা কোটি কোটি বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক নিয়মিত অর্থ পাঠান দেশে। পরিবার-পরিজনের জন্য এই রেমিট্যান্স একদিকে যেমন জীবনধারণের প্রধান ভরসা, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির জন্যও এটি বড় শক্তি। খাবার, ভাড়া, চিকিৎসা ও সন্তানের শিক্ষার খরচ; সবই চলে এই টাকায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই বিপুল রেমিট্যান্স কি শুধু পরিবারের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি এর মাধ্যমে গ্রাম ও কমিউনিটির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সম্ভব? সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক কলামে অভিবাসন ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ লুৎফুল কবির তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপ অনুযায়ী, রেমিট্যান্সের প্রায় ৫৫ দশমিক ৬ শতাংশ খরচ হয় বিভিন্ন ভোগব্যয়ে, যার এক-তৃতীয়াংশই যায় খাদ্য খাতে। এই চিত্র অস্বাভাবিক নয়। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবাসীই স্বল্প বা আধা-দক্ষ শ্রমিক। তারা মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নির্মাণ, কৃষি কিংবা গৃহকর্ম খাতে কাজ করেন। উচ্চ অভিবাসন ব্যয়, অনিশ্চিত চাকরি ও ঋণের চাপ তাদের আয় থেকে সঞ্চয় বা বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত করে দেয়। ফলে রেমিট্যান্সের বড় অংশ ঘুরপাক খায় এক ধরনের ‘ভোগচক্রে’; টাকা আসে, খরচ হয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো ছাপ পড়ে না।
এই বাস্তবতায় রেমিট্যান্সকে নতুনভাবে ভাবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রেমিট্যান্স ব্যক্তিগত অর্থ হলেও এর সামান্য অংশকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা গেলে তা হতে পারে কমিউনিটি উন্নয়নের শক্তিশালী উৎস। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, প্রতিটি রেমিট্যান্স লেনদেন থেকে মাত্র ৫০ সেন্ট স্বেচ্ছায় একটি জাতীয় উন্নয়ন তহবিলে যুক্ত করা হলে কী হতে পারে।
গত বছর বাংলাদেশে এসেছে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) গবেষণা অনুযায়ী, একজন প্রবাসী বছরে গড়ে তিন থেকে চারবার দেশে টাকা পাঠান। প্রতি লেনদেনে গড় অঙ্ক প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ ডলার। এই হিসাব অনুযায়ী বছরে আনুমানিক ১২ কোটি রেমিট্যান্স লেনদেন হয়। প্রতিটি লেনদেন থেকে যদি মাত্র ৫০ সেন্ট করে তহবিলে যোগ হয়, তবে বছরে প্রায় ৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি টাকা জোগাড় করা সম্ভব। এক ডলার হলে এই অঙ্ক আরো দ্বিগুণ হতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের উদ্যোগের উদাহরণ রয়েছে। মেক্সিকোর ‘থ্রি বাই ওয়ান’ কর্মসূচিতে প্রবাসীরা এক ডলার দিলে কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকার মিলিয়ে আরো তিন ডলার যোগ করে কমিউনিটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। মরক্কোতেও প্রবাসী সংগঠন ও স্থানীয় সরকারের যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় উন্নয়ন কর্মসূচি চলছে। ফিলিপাইনে রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ তহবিল, যা সরকারিভাবেই পরিচালিত।
বাংলাদেশও একেবারে পিছিয়ে নয়। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড এবং রেমিট্যান্সে ২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনার মতো ব্যবস্থার মাধ্যমে ইতোমধ্যে একটি কাঠামো তৈরি হয়েছে। এই ব্যবস্থার মধ্যেই যদি সামান্য অতিরিক্ত অবদান যুক্ত করা যায়, তবে তা ব্যাংক বা মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় চাপ হয়ে দাঁড়াবে না। বরং এতে প্রবাসীদের মধ্যে নিজেদের এলাকার উন্নয়নে অংশ নেওয়ার এক ধরনের মালিকানাবোধ তৈরি হতে পারে।
এই তহবিল ব্যবহার করা যেতে পারে ফেরত আসা প্রবাসীদের পুনর্বাসন, ঋণগ্রস্ত শ্রমিকদের সহায়তা, নতুন ব্যবসার জন্য স্টার্ট-আপ গ্রান্ট, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কিংবা গ্রামীণ অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও নিরাপদ পানি প্রকল্পে। তবে সব কিছুর মূল শর্ত হলো আস্থা। প্রবাসীদের বিশ্বাস করতে হবে যে তাদের দেওয়া ৫০ সেন্ট বা এক ডলার অপচয় হবে না।
স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা, বহুপক্ষীয় তদারকি, ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড এবং নিয়মিত স্বাধীন অডিটের মাধ্যমে এই আস্থা তৈরি করা সম্ভব। সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে, এমন একটি উদ্যোগ রেমিট্যান্সকে শুধু পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম নয়, বরং দেশের গ্রাম ও কমিউনিটির টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
logo-1-1740906910.png)