বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল পরিচালনা নিয়ে অচলাবস্থা
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৩
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনা নিয়ে আবারো অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি) এবং টার্মিনাল পরিচালনার জন্য নির্বাচিত জাপানি কনসোর্টিয়ামের মধ্যে একাধিক দফা আলোচনা হলেও মূল বিরোধ রাজস্ব ভাগাভাগি ও আয়-ব্যয়ের কাঠামো নিয়ে কোনো সমাধান হয়নি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার এক প্রতিবেদনে প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ২৪ ও ২৫ নভেম্বর দুই দিনব্যাপী সর্বশেষ আলোচনাও কোনো অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়েছে। কনসোর্টিয়ামের দাবি, সিএএবি বিমানবন্দরের প্রধান কয়েকটি আয়ের খাত থেকে রাজস্ব ভাগ দিতে অনিচ্ছুক এবং ‘ভারতীয় ধাঁচের’ আয়-ব্যয় মডেল চাপিয়ে দিতে চাইছে, যা আন্তর্জাতিক মানের অপারেশন প্রস্তাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
২০২৩ সালের অক্টোবরে সফট লঞ্চ হওয়া তৃতীয় টার্মিনালটির পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরুর কথা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। তবে যন্ত্রপাতি আমদানিতে বিলম্ব, নেতৃত্ব পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক রূপান্তরের কারণে সেই সময়সীমা পিছিয়ে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত গড়িয়েছে। সর্বশেষ অবস্থায় সিএএবি কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা দিতেও পারছে না।
আলোচনা স্থবির হয়ে পড়ায় সরকার এখন বিকল্প পথ হিসেবে আন্তর্জাতিক দরপত্রের বিষয়টি বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দীর্ঘসূত্রতা অব্যাহত থাকলে, কার্যত অলস অবস্থায় থাকা টার্মিনালের বিপরীতে ১৫ হাজার কোটি টাকার জাইকা ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ পড়বে সরকারের ওপর।
সিএএবির মুখপাত্র মোহাম্মদ কাউসার মাহমুদ বলেন, “পরিস্থিতি সম্পর্কে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় ও পিপিপি অথরিটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে।”
সিএএবির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “মূল সমস্যা আর্থিক সমন্বয়। কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব আমাদের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় ও পিপিপি অথরিটির।”
পিপিপি অথরিটির প্রধান নির্বাহী চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানিয়েছেন, আলোচনা চলমান থাকলেও এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।
সিএএবি ও কনসোর্টিয়াম উভয় পক্ষই স্বীকার করছে, রাজস্ব ভাগাভাগিই মূল বাধা। কনসোর্টিয়ামের অভিযোগ, যাত্রী নিরাপত্তা ফি ও বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি এই দুটি লাভজনক আয়ের খাত থেকে রাজস্ব ভাগ না পেলে টার্মিনাল পরিচালনা আর্থিকভাবে টেকসই হবে না। ২০২০ সালের আগস্ট থেকে দেশি ও আন্তর্জাতিক সব যাত্রীর কাছ থেকেই এই দুটি ফি আদায় করা হচ্ছে।
কনসোর্টিয়ামের এক প্রতিনিধি বলেন, “এই আয়ের খাত ছাড়া শুধু গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং রয়্যালটি বা বাণিজ্যিক স্পেস থেকে আয় দিয়ে ব্যয় সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।” তার দাবি, সিএএবির পরামর্শকরা ভারতীয় বিমানবন্দরের মানদণ্ড ধরে হিসাব করেছে, কিন্তু তৃতীয় টার্মিনালের আধুনিক অবকাঠামোর ব্যয় আঞ্চলিক মানদণ্ডে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সিএএবি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, আমদানি করা অনেক ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টি ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে বা শেষের পথে। ফলে দ্রুত অন্তত আংশিক কার্যক্রম শুরু না হলে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ছে।
জাপানের সহায়তায় নির্মিত এই টার্মিনাল বছরে ২ কোটি ৪০ লাখ যাত্রী সেবা দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে তৈরি। বিমান পরিবহন বিশ্লেষক ও বিমানের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “অপারেটর নিয়োগে দেরি হওয়ায় পুরো প্রকল্পই ঝুঁকিতে পড়েছে। কোথাও এত বড় অবকাঠামো বসিয়ে রেখে আয় ছাড়া ঋণের কিস্তি শোধের উদাহরণ নেই।”
তিনি আরো বলেন, আগে জাপানি কনসোর্টিয়ামের ওপর নির্ভরতার কারণে বিকল্প ভাবা হয়নি। এখন সেই কনসোর্টিয়ামই শর্ত দিচ্ছে।
এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে বোর্ডিং ব্রিজ ও ভিজ্যুয়াল ডকিং গাইডেন্স সিস্টেম ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম চালাতে প্রয়োজন হবে প্রায় ৬ হাজার জনবল, যার মধ্যে ৪ হাজারই নিরাপত্তাকর্মী।
সবকিছু ঠিকঠাক হলে তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে শাহজালাল বিমানবন্দরের যাত্রী ধারণক্ষমতা তিন গুণ এবং কার্গো সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ হবে। কিন্তু অপারেটর নিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। ফলে দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
logo-1-1740906910.png)