উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে গ্রিসে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশি যুবকদের লিবিয়ায় পাচার এবং পরে মুক্তিপণ আদায়ের একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি এমনই একটি চক্রের হোতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। চক্রটির সঙ্গে গ্রিসপ্রবাসী এক বাংলাদেশির জড়িত থাকার তথ্যও সামনে এসেছে।
দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেকার ও হতাশাগ্রস্ত যুবকদের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা আদায় করে প্রথমে বিমানে দুবাই পাঠানো হয়। সেখান থেকে মিসর হয়ে তাদের লিবিয়ায় নেওয়া হয়। প্রবাসীদের জানানো হয়, লিবিয়া হয়ে গ্রিসে পাঠানো হবে। কিন্তু লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরই তাদের তুলে দেওয়া হয় সশস্ত্র মাফিয়া চক্রের হাতে।
মাফিয়া সদস্যরা ভুক্তভোগীদের ডলার, ইউরো ও পাসপোর্ট জব্দ করে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখে। এরপর শুরু হয় ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের অডিও-ভিডিও পাঠানো হয় বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের কাছে, দাবি করা হয় মুক্তিপণ। দেশে অবস্থানরত দালাল ও সহযোগীরা এই মুক্তিপণ আদায়ের কাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিপণ দিতে না পারলে মরুভূমিতে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা গেছে।
এই ধরনের ঘটনা শুধু লিবিয়াতেই নয়, ইরাক, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশে ঘটছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জড়িয়ে এমন অপরাধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একই সঙ্গে ঝুঁকির মুখে পড়ছে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় দুটি স্তম্ভ হলো তৈরি পোশাক রপ্তানি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কিন্তু একশ্রেণির অপরাধপ্রবণ প্রবাসী ও দালালচক্রের কারণে অনেক দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এর প্রভাব হিসেবে কোথাও কোথাও শ্রমিক ফেরত পাঠানো হচ্ছে, আবার নতুন করে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে আরোপ করা হচ্ছে বিধিনিষেধ।
এই অপরাধ দমনে শুধু দেশে নয়, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি যারা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে বলা হচ্ছে, এটি কোনো একটি দেশের পক্ষে এককভাবে সমাধানযোগ্য নয়। প্রয়োজন দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা, বিশেষ করে যেসব বিমানবন্দর ও ট্রানজিট রুট এই চক্র ব্যবহার করছে, সেখানে যৌথ নজরদারি জোরদার করা।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকটের মূল কারণ অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা। বৈধ অভিবাসনের সুযোগ না পেয়ে অনেকেই আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পা দেন। ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার পথে ৯৩ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি হন এবং ৭৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ইউরোপীয় সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্সের তথ্যে বলা হয়েছে, লেবানন হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকারীদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপজ্জনকভাবে বিদেশ গমন ঠেকাতে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং বৈধ অভিবাসনের পথ সহজ করা জরুরি। তা না হলে হতাশা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় নামা মানুষের সংখ্যা কমবে না, আর প্রবাসে অপমান ও নির্যাতনের এমন ঘটনাও চলতেই থাকবে।
logo-1-1740906910.png)