‘এক কিডনির গ্রাম’: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অঙ্গ পাচারের আতঙ্ক

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৯

বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার বাইগুনি নামের একটি গ্রাম এখন ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে পরিচিত। এই গ্রামে এমন বহু মানুষ রয়েছেন, যারা দারিদ্র্য, ঋণগ্রস্ততা কিংবা সামাজিক সংকটে পড়ে নিজেদের কিডনি বিক্রি করেছেন। সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে মানব অঙ্গ পাচার এখন একটি চক্রবদ্ধ ও সংগঠিত ব্যবসা, যার শিকার হচ্ছেন অসংখ্য দরিদ্র মানুষ।
আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাইগুনির ৪৫ বছর বয়সী সাফিরুদ্দিন ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ভারতে কিডনি বিক্রি করেন ২০২৪ সালে। দালালরা তাকে মেডিকেল ভিসার ব্যবস্থাপনায় ভারতে নিয়ে যান। সেখানে ভুয়া পারিবারিক সম্পর্কের সনদ, জাল জাতীয় পরিচয়পত্র এবং মনগড়া ডিএনএ রিপোর্ট তৈরি করে তাকে আত্মীয় হিসেবে দেখানো হয়। অস্ত্রোপচারের পর তার পাসপোর্ট ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত নথি কেড়ে নেওয়া হয়, ফলে তিনি আইনি কিংবা স্বাস্থ্য সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হন। “আমি জানি না, আমার কিডনি কে পেয়েছে। তারা কিছুই বলেনি” বলেন তিনি।
২০২৩ সালের একটি গবেষণা বলছে, কালাই উপজেলার প্রতি ৩৫ জনে একজন মানুষ কোনো না কোনো সময়ে কিডনি বিক্রি করেছেন। এই বিক্রয়ের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে ৮৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যকে দায়ী করেছেন। গবেষণাটিতে দেখা গেছে, ভারতে বছরে প্রায় দুই লাখ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন, অথচ আইনগতভাবে ট্রান্সপ্লান্ট হয় মাত্র ১৩,৬০০টি। এই চাহিদার ঘাটতি পূরণে গড়ে উঠেছে অবৈধ অঙ্গ-বাজার, যেখানে বাংলাদেশ অন্যতম উৎস।
এই চক্রের শিকার শুধু পুরুষ নন, নারীরাও। ৪৫ বছর বয়সী জোৎস্না বেগম ও তার স্বামী বেলাল ২০১৯ সালে ৭ লাখ টাকার প্রতিশ্রুতি পেয়ে কিডনি দেন, কিন্তু হাতে পান মাত্র ৩ লাখ টাকা। অস্ত্রোপচারের কিছুদিন পর বেলাল জোৎস্নাকে ছেড়ে চলে যান, তিনি এখন চিকিৎসা ও জীবিকা সংকটে। “আমি ভারী কোনো কাজ করতে পারি না। সারাক্ষণ ওষুধ লাগে” বলেন জোৎস্না।
একসময় ব্যবসায়ী ছিলেন সজল (ছদ্মনাম)। ব্যবসা ভেঙে যাওয়ার পর ঋণের চাপে পড়ে তিনিও দালালদের কথায় কিডনি বিক্রি করেন। প্রতিশ্রুতি ছিল ১০ লাখ টাকা, কিন্তু পান মাত্র সাড়ে তিন লাখ। পরে জীবনধারণের তাগিদে নিজেই দালাল হয়ে ওঠেন। তবে চক্রের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়ার পর তিনি জীবনহানির আশঙ্কায় রয়েছেন।
বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, সীমান্তবর্তী এলাকায় অঙ্গ পাচার চক্র দমনে অভিযান চলছে। গোপন তদন্তকারী দল গঠিত হয়েছে এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে অনেক চক্রই ভারতে নিবন্ধিত কিছু হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। ভারতে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও সেগুলো সীমিত এবং বিচ্ছিন্ন।
এই চক্রের ভয়াবহতা কেবল আইন লঙ্ঘনের বিষয় নয়; এটি দারিদ্র্য, মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং সীমান্তনির্ভর দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে আসে। বাইগুনি এবং এর আশপাশের গ্রাম এখন মানব অঙ্গ পাচারের এক জ্বলজ্যান্ত ক্ষতচিহ্ন, যেখানে মানুষের শরীর বেঁচে জীবন টিকিয়ে রাখার নিষ্ঠুর লড়াই চলছে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা