ড. তাসনিম সিদ্দিকীর বিশেষ সাক্ষাৎকার - ১ম পর্ব
তাহলে কি মালয়েশিয়ায় সিন্ডিকেশনটা থেকেই যাচ্ছে?

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ১৫:৩৪

ড. তাসনিম সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তার মূল গবেষণা আন্তর্জাতিক অভিবাসন নিয়ে। ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট- রামরুর তিনি অ্যাকটিং এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। অন্তর্বর্তী সরকারের ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য তিনি। অভিবাসন সমস্যা এবং মালয়েশিয়া ও সৌদির শ্রমবাজার নিয়ে মাইগ্রেশন কনসার্নের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন ড. সিদ্দিকী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব স্মারক। আজকে থাকছে প্রথম পর্ব।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: দেশের জন্য অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। সেখানে সিন্ডিকেটের কারণে অনেক সমস্যা আমরা আগে দেখেছি। নতুন করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মালয়েশিয়ায় গিয়ে দেশটির সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং করে শ্রমবাজার খোলাসহ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার জন্য বৈঠক করলেন। তাতে অনেক সুখবর গণমাধ্যমে আমরা দেখেছি। তাহলে কী এটা ভেবে নেয়া যায়, এই শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটের সমস্যার কী সমাধান হয়ে গেল?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: কিছু দিন আগে মালয়েশিয়া সরকার জানিয়েছে, তারা আবার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেবে। ১৪টি কলিং কান্ট্রি থেকে মালয়েশিয়া শ্রমিক নেয়, তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকার তো চাইবে, দেশটিতে যেন শ্রমিকরা যায়। সে জন্য তারা উদ্যোগও নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে একটা দল এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নেতৃত্বে মালয়েশিয়া সফর করেছে। সেখানে গিয়ে তারা চেষ্টা করেছে নেগোসিয়েশনের। নেগোসিয়েশনের সময় যে কথাগুলো এসেছে, তাতে আমি যেটা অনুধাবন করি, এখন পর্যন্ত কিন্তু অন্যান্য দেশ থেকে যেভাবে মালয়েশিয়া লোক নেয়, বাকি ১৪টি দেশ থেকে, যেখানে মালয়েশিয়া সরকার তার দেশে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি দিয়ে লোক নেবে, তা বাছাই করে দেবে এমন কোনো শর্ত সেখানে থাকে না। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে শর্তটা রয়েছে, সেটা না উঠিয়ে এই এমওইউর মাধ্যমেই লোক নেয়ার ব্যবস্থা হতে পারে। যদি সেটা হয়, তাহলে কিন্তু সেই সিন্ডিকেশনটাই আবার হচ্ছে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: তাহলে কী বলছেন, পুরনো ব্যবস্থার দিকেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ফেরত যাচ্ছে বা পুরনো ব্যবস্থাই বলবৎ থাকছে?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: এবার যেটা আমরা শুনতে পাচ্ছি, তারা ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে নিয়ে সিন্ডিকেট করতে চাচ্ছে। শোনা গেছে, এর আগে ৫ কোটি টাকা করে নেয়া হয়েছিলো পার রিক্রুটিং এজেন্সি হিসেবে, যারা এই সিন্ডিকেটের অংশ হয়েছিলেন। অবশ্য পলিটিক্যাল লিডাররা পয়সা দেননি, তারা দিয়েছিলেন কানেকশন। অন্যদিকে এবার নাকি ১৪ কোটি টাকা প্রতিটি রিক্রুটিং এজেন্সি করে নেবে। তাহলে আপনারা বুঝতেই পারছেন, যদি সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই লোক যায়, গতবার যেখানে সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা করে প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে, সেখানে অনেকে কিন্তু সেখানে কাজ পাননি। সেই ব্যবস্থাটাই কিন্তু চালু থাকবে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: তাহলে তো এই শ্রমবাজারে যে তিন-চার গুণ অভিবাসন খরচ বাড়ে, তা আরো বাড়তে পারে?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: হ্যাঁ, ব্যবস্থাটা যদি জারি থাকে, তাহলে তো অভিবাসনের ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এ রকম ক্ষেত্রে কেন আমার কাছে এটা বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। কারণ আমরা জানি, মালয়েশিয়াকে হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের যে অভিযোগটা দেয়া হয়েছে, সেটা কিন্তু দিয়েছে ইউএন বডি, তাদের কাছ থেকে বিষয়টি এসেছে। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকার, যেটা শোনা যাচ্ছে যে, আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীর দলকে বলেছে, ট্রাফিকিংয়ের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিতে। তাহলে ট্রাফিকিংয়ের মামলাগুলো কার বিরুদ্ধে? এই মামলা কিন্তু সেই রুহুল আমিন আর মালয়েশিয়ার দাতো আমিনের বিরুদ্ধে। এই দুই গোষ্ঠী, যারা সিন্ডিকেট করেছে এবং বাংলাদেশে যে মামলাটা হয়েছে, সেটা প্রত্যাহারের অনুরোধ করার মানে কী? এই দুইজনকে আবারো কাজ করবার সুযোগ করে দিতে হবে। এই পরিস্থিতিটা একটা ভালো ফলাফল দিবে বলে আমি অতটা আশাবাদী হতে পারছি না। তার চেয়ে বরং আমরা যদি চেষ্টা করি, মালয়েশিয়ায় আমাদের বহু লোক, যারা আগেরবার গিয়েছিলেন, টাকা-পয়সা খরচ করে কাজ পাচ্ছেন না। সেই মানুষগুলোকেই যদি আবার নতুন করে ভিসা দেয়া হয়, তাহলে বরং বিনা পয়সায় বাংলাদেশের জন্য একটা ভালো চুক্তি হয়েছে এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে, সেটা ভেবে আমরা আনন্দিত হতে পারি।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: এর মাঝে আমরা দেখছি, মালয়েশিয়ায় কর্মী-শ্রমিকরা অনেক বেশি হারে অবৈধ হয়ে পড়ছেন। বড় ধরনের গ্রেফতার অভিযান চললে বাংলাদেশিরাই বেশি গ্রেফতার হচ্ছেন। সরকার এ ক্ষেত্রে কী করতে পারে?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: ভিসা যদি এক্সপায়ার হয়ে যায়, মালয়েশিয়া সরকার এ ক্ষেত্রে কিন্তু চরমভাবে শক্ত। মালয়েশিয়া সরকার সব সময় চাইবে তাদের ফেরত পাঠাতে। সে ক্ষেত্রে যদি তেমন কোনো নেগোসিয়েশন করা যেত, অতীতে কিন্তু করা গেছে। আবার পাসপোর্ট দিয়ে, নতন করে পাসপোর্ট ইস্যু করে, হাজার হাজার পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে একসময়, তারপর তাদের বৈধ করে নেয়ার একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। এখন যদি আমরা সে ধরনের একটা নেগোসিয়েশন করতে পারি, সেটা একটা ভালো ব্যাপার হবে। মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিম এমন এক ধরনের প্রাইম মিনিস্টার তিনি কিন্তু মানব দরদি, পিপল সেন্ট্রিক একজন ব্যক্তি। কিন্তু দেশের অন্যান্য জায়গায় শোনা যায়, বিভিন্ন রকমের একটা করাপশনের জায়গা আছে। সেই জায়গাটা কাটিয়ে আমরা যদি অন্যভাবে গিয়ে চেষ্টা করি, তাহলে হয়তো বা পারা সম্ভব। আমার মনে হয় এটা বেশ কঠিনই হবে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন: আবার মালয়েশিয়াতে ই-পাসপোর্টের সংকট কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি...
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: এটা একটা চিরাচরিত অব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের। দেখুন প্রত্যেককে কিন্তু ওই দেশে ভিসা রিনিউ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে তার পাসপোর্টের ডেটটা কিন্তু পরবর্তী সময় পর্যন্ত থাকতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ওই দেশের যে দূতাবাস, এই পাসপোর্টটা দিতে প্রচণ্ড রকম বিলম্ব ঘটিয়েছেন। অনেক সময় মালয়েশিয়ানদের হাতে তুলেও দেয়া হয়েছে এই পাসপোর্ট দেয়ার ব্যাপারটা। তারপরও সেটার কোনো ভালো সমাধান দিতে পারেনি। এটা হলো সরকারের একটা দক্ষতার জায়গা। এই দক্ষতার জায়গাটা সরকারকে যে কোনো মূল্যে বাড়াতে হবে।
চলবে…