
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্সের পাশাপাশি সরাসরি বিনিয়োগ এবং বিভিন্ন বিনিয়োগ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন৷ জুলাই ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ গড়ে ২৭.৫১ বিলিয়ন (২ হাজার ৭৫০ কোটি ৭০ লাখ) ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮.৭ শতাংশ বেশি। শুধু রেমিট্যান্সেই সীমাবদ্ধ না থেকে প্রবাসীরা ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, বিনিয়োগ সম্মেলন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন, যা ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে। এই অর্থনৈতিক প্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করে, ফোরেক্সের স্থিতিশীলতা আনে এবং গৃহীত রেমিট্যান্স থেকে গ্রামীণ ও শহর উভয় অঞ্চলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্ম দিচ্ছে। তবে অবৈধ হুন্ডি চ্যানেল, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সীমাবদ্ধতা এবং ফেরত প্রবাসীদের দক্ষতার অভাব ঝুঁকির উদ্রেক করছে, যা মোকাবিলায় সম্প্রসারিত কৌশল, প্রণোদনা এবং রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের উদ্যোগ প্রয়োজন।
১. প্রবাসী রেমিট্যান্স: প্রবৃদ্ধি ও এর প্রভাব
১.১ গড় রেমিট্যান্স প্রবাহ
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মে (১১ মাস) সময়ে প্রবাসী আয় ছিল ২৭.৫১ বিলিয়ন ডলার, যা ২৮.৭ শতাংশ বেড়েছে।
২০২৫ সালের মে মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২.৯৭ বিলিয়ন (২৯৭ কোটি) ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১.৭ শতাংশ বেশি ।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স আয় ছিল ২.৬১ বিলিয়ন ডলার, যা দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হিসেবে ধরা হয়েছে।
১.২ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ফোরেক্স স্থিতিশীলতা
রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে ডলার বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল হচ্ছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ২০২৫ সালের মে মাসে ডলার ক্রয় মূল্য সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়, যা রেমিট্যান্সের ধাক্কায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সুরক্ষায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ভূমিকা পালন করছে, যা আমদানি-রপ্তানিতে ভারসাম্য রক্ষা করে।
২. প্রবাসীদের সরাসরি বিনিয়োগ
২.১ ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড
প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের পাশাপাশি ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগ করছেন, যা ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করা হয়েছে ।
এই বন্ডে বিনিয়োগকারী প্রবাসীরা ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত করমুক্ত সুবিধা পাচ্ছেন, ফলে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা তুলনামূলক নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন।
পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে, কারণ বিনিয়োগে দেশের ব্যাংকিং সেবা সহজলভ্য হচ্ছে এবং ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে।
২.২ বিনিয়োগ সম্মেলন ও উদ্যোক্তা প্রবাসীরা
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫-এ অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন দেশের প্রবাসী উদ্যোক্তা, যেখানে স্থানীয় শিল্প খাতে বিনিয়োগের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা মধুপুর, চট্টগ্রাম এবং খুলনা অঞ্চলে হোটেল, খাদ্য-প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে, সৌদি ‘সারি’ ও ঢাকার ‘শপআপ’ মিলে তৈরি করেছে ‘সিল্ক গ্রুপ’, যেখানে ইতোমধ্যে ১১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে।
লুফতাই সিদ্দিকী এবং অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের উৎপাদন, জ্বালানি, ব্যাংকিং এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলা হয়েছে।
২.৩ কিছু চ্যালেঞ্জ এবং প্রয়োজন
প্রবাসী বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ফি, লেনদেনের জটিলতা এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক বাধা সমস্যার সৃষ্টি করছে।
দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলোকে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, সেমিনার আয়োজন এবং প্রযুক্তি-উদ্যোগী ধারণা প্রদানে ভূমিকা রাখতে বলা হয়েছে।
সরকারকে বিনিয়োগ অনুকূলে প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে প্রবাসীরা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীল খাতে অর্থায়ন করতে উৎসাহিত হয়।
৩. ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্ম: রেমিট্যান্সের গতি
৩.১ গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি
রেমিট্যান্সের একাংশ পরিবারগুলো নিজেদের গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শহরে কিংবা নতুন শহরতলির বিজনেস শুরুতে ব্যয় করছেন, যার ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার বিকাশ ঘটছে।
বিশেষ করে কৃষি ও খুচরা ব্যবসা, খাদ্য প্রসেসিং এবং হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িত গ্রামীণ পরিবারের সদস্যরা রেমিট্যান্সের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করে ব্যবসা শুরু করছেন।
রেমিট্যান্সভিত্তিক ঋণপ্রাপ্তি (রেমিট্যান্স বীমা বা রেমিট্যান্স-আস্ত নির্ভর ঋণ) গড়ে তুলেছে গ্রামীণ ব্যাংক এবং মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান, যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তা করছে।
৩.২ শহরাঞ্চলের ক্ষুদ্র উদ্যোগ
ঢাকার উপকণ্ঠ নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং চট্টগ্রাম এলাকায় প্রাপ্ত রেমিট্যান্সে নতুন অনলাইনভিত্তিক ক্ষুদ্র স্টার্টআপ ও হোমভিত্তিক ব্যবসার সংখ্যা বেড়েছে।
অনলাইনে বিপণন, ফুড ডেলিভারিসহ অন্যান্য পরিষেবা খাতে পরিবারের তরুণরা রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে কাজ শুরু করছেন, যা শহরজুড়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।
জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, রেমিট্যান্স উপার্জনশীল পরিবারগুলোর গৃহীন-খুচরা ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০-১৫ শতাংশ, যা সেবার খাতেও উন্নয়ন নিয়ে এসেছে।
৪. অর্থনীতিতে বহুমুখী প্রভাব
৪.১ জিডিপি ও প্রবৃদ্ধি
রেমিট্যান্স বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ দান করে, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় সহায়তা করেছে
প্রবাসী বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সের সমন্বয় বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করেছে, বিশেষত জ্বালানি ও আমদানির জটিলতার মধ্যেও অর্থনীতির গতি বজায় রাখছে
৪.২ বৈদেশিক বিনিয়োগ আহ্বান
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ইমেজ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার অংশ হিসেবে প্রবাসী উদ্যোক্তারা দেশের উন্নয়নশীল খাতে অংশ নিচ্ছেন।
সরকারের ‘এক দেশ, এক বাজার’ নীতি এবং বিনিয়োগ সহজীকরণ পরিকল্পনাগুলো প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের আস্থা জাগিয়েছে
৫. চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ
৫.১ অবৈধ চ্যানেল ও ডিজিটাল লেনদেন
অনেক প্রবাসী হুন্ডি চ্যানেলের দিকে ঝুঁকছেন, কারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা সীমিত।
ডিজিটাল রেমিট্যান্স প্ল্যাটফর্মগুলো (জিএমপি, বিডি রিমাইন্ড, ওয়ালেট) আরো কার্যকর করতে হবে, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শ্রমিকরাও সহজে বৈধপথে টাকা পাঠাতে পারেন।
রেমিট্যান্সের ট্রানজেকশন খরচ কমিয়ে দিতে হবে এবং লেনদেনের সময় কমিয়ে দেশের প্রবাসীদের উৎসাহ বাড়াতে হবে।
৫.২ ফিরে আসা প্রবাসীদের উদ্যোগ
ফেরত প্রবাসীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদেশি মিশনগুলোকে প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন করতে হবে।
বিদেশফেরত শ্রমিকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ঋণ, অনুদান এবং প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে তারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হতে পারেন।
ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডের মতো প্রবর্তনগুলোতে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার-প্রচারণা ও হেল্পডেস্ক চালু করতে হবে, বিশেষ করে রেমিট্যান্সনির্ভর গ্রামের মানুষদের জন্য।
৫.৩ নীতি ও প্রণোদনা
সরকারকে প্রবাসী বিনিয়োগে করমুক্ত সুবিধা, লভ্যাংশ রেমিট্যান্স ছাড়াই উত্তোলন সহজীকরণ এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধা প্রদান করতে হবে
বাংলাদেশ দূতাবাস ও হাইকমিশনকে প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে প্রতি মাসে সেমিনার আয়োজন, নতুন বিনিয়োগ এভিনিউ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে
স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে প্রবাসী রেমিট্যান্সভিত্তিক ঋণ প্রদানে সহায়তা করার জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম চালু এবং সফটওয়্যারভিত্তিক লেনদেন কার্যকর করতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিরাট ভান্ডার জোগাচ্ছেন এবং বৈধ বিনিয়োগের পথ সন্ধান করে শিল্প খাতে অবদান রাখছেন। স্টার্টআপে বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের সমন্বয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্ম দিচ্ছেন, যা দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতির বহুমাত্রিক উন্নয়নে সহায়ক। তবে অবৈধ চ্যানেল, দক্ষতার ঘাটতি এবং প্রশাসনিক বাধা অতিক্রম করার জন্য সরকার, ব্যাংক এবং প্রবাসী সংগঠনগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে।
যথাযথ প্রণোদনা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রসার এবং ফেরত প্রবাসীদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির পারস্পরিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
মাইগ্রেশন কনসার্ন রিপোর্ট