
বাংলাদেশের অর্থনীতি যে দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রবাসীদের বিদেশযাত্রা এখনো পুরোপুরি নিরাপদ হতে পারেনি। অতিরিক্ত ব্যয়, দালালের খপ্পর, সমুদ্রপথে বিদেশ গমন, পর্যটন ভিসায় গিয়ে থেকে যাওয়া, এক দেশে গিয়ে অন্য দেশে চলে যাওয়াসহ নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। এতে দেশ হিসেবে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমাদের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতার দিকে তাকালে আমরা এ ভয়াবহ পরিস্থিতি আরো বুঝতে পারি। বৈদেশিক বিনিয়োগে দীর্ঘদিন ধরেই ভাটা চলছে। তার ওপর বিগত সরকার ও সংশ্লিষ্টরা বড় অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এতে দেশে নতুন কারখানা স্থাপন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। দেশের ২৬ বছর গড় বয়স এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আট কোটির মতো। বিশাল এ তরুণ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই শোভন কর্মসংস্থান পাচ্ছেন না। ফলে তারা যে কোনো উপায়ে বিদেশযাত্রাকে একমাত্র পাথেয় মনে করছেন। এতে নিজের জীবন বিপন্ন করার পাশাপাশি পরিবারকেও ঝুঁকিতে ফেলছেন তারা। একই সঙ্গে বাংলাদেশিদের নিয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে।
বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক বছর বাংলাদেশি পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছিল ভিয়েতনাম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি ঘুরতে গিয়ে বাংলাদেশিদের কেউ কেউ প্রতিবেশী কম্বোডিয়া বা লাওসেও যেতেন। তবে ভিয়েতনামে পর্যটক হিসেবে ঘুরতে যাওয়া বাংলাদেশিদের অনেকে আর দেশে ফেরেননি। কর্মসংস্থানের উদ্দেশে তাদের অনেকেই অবৈধ পথে ভিন্ন গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছেন; আবার কেউ সেখানেই ট্যুরিস্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ছোটখাটো কাজে যুক্ত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দিয়েছে ভিয়েতনাম। অথচ কয়েক বছর আগেও ভিয়েতনাম কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় যেতে বাংলাদেশিদের কোনো ভিসার প্রয়োজন হতো না। এ ক্ষেত্রে অন অ্যারাইভাল ভিসা বা ইমিগ্রেশন অ্যাপ্রুভাল নিয়েই দেশ দুটি ভ্রমণ করা যেত। বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা অনুমোদনে নানা শর্ত ও জটিলতা বাড়িয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াও। এ তিন দেশের অনেক ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। যারা বেশ কয়েকবার এসব দেশ ভ্রমণ করেছেন তাদের ভিসা আবেদনও অনুমোদন হচ্ছে না। বাংলাদেশিদের ভিসা ইস্যুর জন্য নতুন অনেক শর্তও জুড়ে দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এর আগেও মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যেতে নানা শর্তের মুখোমুখি হতে হয়েছে বাংলাদেশিদের। গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ইস্যু বন্ধ করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় সম্প্রতি বাংলাদেশিদের জন্য সীমিত পরিসরে ভিসা চালুর ঘোষণা দিয়েছে তারা। তবে এ ক্ষেত্রে দিনে ভিসা দেয়া হচ্ছে মাত্র ৩০ থেকে ৫০টি। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানেও ভ্রমণ সীমিত হয়ে গেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করে পাকিস্তান। ঢাকা-করাচি সরাসরি ফ্লাইট চালুর বিষয়ে আলোচনা এগিয়েছিল। বাংলাদেশি পর্যটকদের অনেকে পাকিস্তানে যেতে আগ্রহীও হয়েছিলেন। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক যুদ্ধ ও পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বাংলাদেশিদের সে আগ্রহেও ভাটা পড়ছে।
এদিকে অভিবাসন ও পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা না বেড়ে উল্টো কমছে। আন্তর্জাতিক সূচকে (হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স) বাংলাদেশি পাসপোর্টের অবস্থান এখন উত্তর কোরিয়া কিংবা লিবিয়ার পর্যায়ে। এ কারণে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসার শর্ত ও জটিলতা বাড়ছে। এর পেছনে যে কারণগুলো সামনে আসছে তার মধ্যে রয়েছে, ঘুরতে গিয়ে আর না ফেরা। গত কয়েক বছর পর্যটক হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঘুরতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি আর ফেরেননি। অবৈধভাবে তারা ওই দেশে থেকে গেছেন কিংবা চোরাই পথে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছেন। এসব কারণে এ অঞ্চলের দেশগুলোয় বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ইস্যু বন্ধ হচ্ছে কিংবা জটিলতা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ না বাড়লে বাংলাদেশিদের অবৈধ বিদেশযাত্রা থামানো যাবে না। দেশে প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি স্নাতকধারী চাকরিপ্রত্যাশী বাড়ছে। সরকারি খাতে কর্মসংস্থান লোভনীয় হলেও আসন সীমিত। এদিকে বেসরকারি খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। আবার বেসরকারি খাতে যে সক্ষমতার কর্মী চাওয়া হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তা প্রদানে পুরোপুরি সক্ষম নয়। এ জন্য মধ্য থেকে শীর্ষ পর্যায়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য দেশ থেকে কর্মী আনা হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা কাঠামোকে ঢেলে সাজালে উচ্চ বেতনের এসব চাকরিতে দেশীয় তরুণরা যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেতেন। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগবঞ্চিত তরুণরা যে কোনো উপায়ে বিদেশ পাড়ি দিয়ে ভাগ্য গড়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েন। এ কারণে শিক্ষার্থী ভিসা কিংবা পর্যটক ভিসায় গিয়ে বিদেশে কাজ করছেন। এছাড়া কেউ ভূমধ্যসাগর হয়ে ছোট্ট নৌকায় ইউরোপ পাড়ি দিতে যান, আবার কেউ-বা জলপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় যেতে চান। পথে প্রাণহানিসহ মানব পাচার চক্রের শিকার হতে দেখা যাচ্ছে অজস্র বাংলাদেশিকে। তার ওপর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়াই অদক্ষ শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে বিদেশে। ভাষাগত দক্ষতা, সংস্কৃতিগত পরিচয় ও প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতার ঘাটতি বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সুনাম কমিয়েছে। এতে ভিসা ইস্যু নিয়ে জটিলতা ও নিষেধাজ্ঞা বাড়ছে, বিদেশে বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতাও কমছে। প্রতি বছর বিশ্বের ১৯৯টি দেশের পাসপোর্ট ও ২২৭টি ভ্রমণ গন্তব্য নিয়ে শক্তিশালী পাসপোর্ট সূচক প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত সর্বশেষ সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে বাংলাদেশি পাসপোর্টের অবস্থান ছিল ৯৫তম। বাংলাদেশের ওপরে ৯৪তম স্থানে আছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা উত্তর কোরিয়া। আর বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে একই অবস্থানে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার নাম।
যেহেতু দেশে আমরা সবার কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারছি না, সেহেতু তরুণরা প্রবাসমুখী হবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে বিদেশগামী অভিবাসী শ্রমিকরা যেন শিক্ষিত ও দক্ষ হন, সেদিকে জোর দেয়ার কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। আর কেউ যাতে ভুয়া ভিসা কিংবা ভুয়া তথ্য দিয়ে বিদেশ যেতে না পারেন, সেটি নিশ্চিত করা সরকারের কাজ।
বিশাল জনগোষ্ঠীর এ দেশে সবার শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা কঠিন। তার ওপর বিভিন্ন প্রযুক্তি এসে অনেক পেশাকে নাই করে দিচ্ছে। তাই বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠানো আমাদের জন্য অনিবার্য একটি সত্য। এছাড়া প্রথম বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন খাতে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের সে সুযোগগুলো গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা পাঠক্রমে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যুগোপযোগী বিষয়াবলি যুক্ত করতে হবে; বাজার, কর্ম ও দক্ষতামুখী শিক্ষা প্রণয়ন করতে হবে। দেশে উদ্যোক্তা ও দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরির পাশাপাশি বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠানোর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ফিলিপাইন দক্ষ সেবিকা ও পরিচারিকা পাঠিয়ে আমাদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি রেমিট্যান্স আয় করছে। মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি উত্তর আমেরিকা, ইউরোপসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। আমরা সুপ্রশিক্ষিত শ্রমিক পাঠালে তা যেমন আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াবে, তেমনি বিশ্বমঞ্চে আমাদের সুনাম বাড়াবে। অবৈধ পথে ও প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশ গমন নিরুৎসাহিত করতে টিভি-বেতারসহ গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় এ বিষয়ে সচেতনতামূলক পাঠ্যবস্তু যুক্ত করতে হবে। সরকারি বিভাগগুলোকে হয়রানির জায়গা না হয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও নিরাপত্তা প্রাপ্তির ক্ষেত্র হতে হবে। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পাসপোর্টের যে মান তা রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। সরকারি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
তথ্যসূত্র: দৈনিক বণিক বার্তা