Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদেশি কর্মী নিয়োগে কঠোর হচ্ছে সরকার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৯

দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদেশি কর্মী নিয়োগে কঠোর হচ্ছে সরকার

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশীয় শ্রমবাজারে যেখানে পর্যাপ্ত স্থানীয় জনশক্তি রয়েছে, সেখানে আর কোনো বিদেশি সাধারণ শ্রমিক; যেমন- ফ্যাক্টরি অপারেটর, টেকনিশিয়ান, মধ্যম পর্যায়ের ম্যানেজার বা প্রকল্পকর্মী নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হবে না। শুধু বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বিদেশি কর্মী নিয়োগই এখন থেকে অনুমোদন পাবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য হলো দেশীয় নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় রোধ করা এবং কর ফাঁকি নিয়ন্ত্রণে আনা। 

অপ্রয়োজনীয় বিদেশি নিয়োগ বন্ধের এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে। বৈঠকে আরো সিদ্ধান্ত হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মরত সাধারণ বিদেশি শ্রমিকদের ওয়ার্ক পারমিট মেয়াদ শেষে আর নবায়ন করা হবে না। এরই মধ্যে পুলিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ (SB)-এর তিনটি দল বিদেশিদের ভিসা শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনা চিহ্নিত করতে মাঠে নেমেছে। যেসব বিদেশি অনুমোদিত পেশার বাইরে অন্য কোথাও কাজ করছেন, তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এ ধরনের অনিয়মের কারণে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশিকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। 

সরকার অন-অ্যারাইভাল ভিসা প্রক্রিয়ায়ও পরিবর্তন আনছে। যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন রয়েছে, সেসব দেশের নাগরিকদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করা হবে। তবে সরকারি আয়োজনে আগত অতিথি, কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি, জাতিসংঘ ও প্রতিরক্ষা সংস্থার প্রতিনিধি এবং আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী ক্রিকেট খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। অন্যান্য খেলাধুলার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ফুটবলারদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ থাকবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বিদেশি কর্মীদের তথ্যভাণ্ডার তৈরির জন্য একটি বিশেষ সফটওয়্যার চালু করেছে। এর পাশাপাশি অন-অ্যারাইভাল ভিসা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি মোবাইল অ্যাপও চালু হয়েছে। মন্ত্রণালয় শিগগিরই একটি সার্কুলার জারি করবে, যেখানে নতুন নিয়ম-কানুন বিস্তারিতভাবে উল্লেখ থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শামীম খান জানিয়েছেন, সফটওয়্যার ও অনলাইন তথ্যভাণ্ডার তৈরির মাধ্যমে বিদেশি কর্মীদের গতিবিধি আরো কার্যকরভাবে নজরদারির আওতায় আনা যাবে।

সরকার এর আগেও অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিদের আইনি প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি নোটিশ জারি করে বিদেশিদের বৈধ কাগজপত্র নিয়ে অবস্থান নিশ্চিত করতে বলে। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জানুয়ারির ৩১ তারিখ পর্যন্ত নিয়মিতকরণে আবেদন করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর ফেব্রুয়ারিতে সরকার ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি টাস্কফোর্স গঠন করে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত সচিব শামীম খান। এই টিমের কাজ হলো অবৈধ বিদেশিদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ১,৩৯,০০০ জন বৈধ বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছিলেন। তবে ডিসেম্বর মাসে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, আরো প্রায় ৪৬ হাজার বিদেশি অবৈধভাবে দেশে অবস্থান করছেন। সরকারের ঘোষণার পর প্রায় ১৫ হাজার জন দেশ ছেড়েছেন এবং বাকি অনেকে বৈধতার জন্য আবেদন করেছেন। বর্তমানে মোট আনুমানিক ১,৭৫,০০০ বৈধ বিদেশি বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।

বিদেশি শ্রমিকদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন-অ্যারাইভাল ভিসায় আগতরা কতদিন ছিলেন বা চলে গেছেন কিনা, এ সংক্রান্ত ডাটা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে অনুমান করা হচ্ছে, দেশে অবস্থানকারী বিদেশিদের অর্ধেকের বেশি সাধারণ শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB)-এর ২০২০ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে আইনি ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশির সংখ্যা প্রায় ২,৫০,০০০। প্রতি বছর এদের মাধ্যমে গড়ে ৩.১৫ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয় এবং সরকার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারায়। এই গবেষণায় আরো দেখা গেছে, ৪৪টিরও বেশি দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশে কাজ করছেন। বিশেষ করে ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, তুরস্ক, ফিলিপাইন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে আসা নাগরিকরা বিভিন্ন শিল্প ও খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশিয়ান কর্মীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

বিদেশিরা মূলত তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাত, উন্নয়ন প্রকল্প, বহুজাতিক কোম্পানি, বিদ্যুৎকেন্দ্র, এনজিও, স্বাস্থ্য ও হোটেল খাতে কাজ করছেন। কয়েক হাজার বিদেশি বাংলাদেশে খেলোয়াড়, শিক্ষার্থী কিংবা কনসালট্যান্ট হিসেবেও অবস্থান করছেন।

বাংলাদেশের আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বিদেশি নাগরিকদের আয়ের উপর ৩০% হারে উৎসে কর কর্তন বাধ্যতামূলক। এই নিয়ম না মানলে নিয়োগকর্তা বা বিদেশি উভয়কেই অর্থদণ্ড বা কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হয়। অর্থ বিভাগের হিসাবে, এই খাত থেকে বার্ষিক রাজস্বের একটি বড় অংশ কর ফাঁকির কারণে হারিয়ে যাচ্ছে।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান মনে করেন, অপারেটর ও টেকনিক্যাল পর্যায়ে স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত দক্ষ কর্মী থাকায় এই পদক্ষেপ শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, বর্তমানে ফ্যাশন টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাজার-প্রাসঙ্গিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণরা বের হচ্ছেন। তবে তিনি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বিদেশি নিয়োগের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করেছেন, বিশেষ করে নতুন প্রযুক্তি ও পণ্য চালুর সময়।

সরকারের এই পদক্ষেপ যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে দেশীয় কর্মসংস্থান বাড়বে, অবৈধ অর্থ পাচার রোধ হবে এবং বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ অভিবাসন ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তথ্যসূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড 

Logo